মন খুলে ভালবাসুন!
একজন পুরুষ ও একজন নারী বিবাহ বন্ধনে
আবদ্ধ হয়ে যখন একসঙ্গে জীবন যাপন
করতে শুরু করে, তখনই একটি পরিবারের
ভিত্তি স্থাপিত হয়। এখানে পুরুষকে স্বামী
আর নারীকে স্ত্রী বলা হয়। এ দু’য়ের
সম্মিলিত ভালবাসাপূর্ণ সামগ্রিক
জীবনকেই বলা হয় ‘দাম্পত্য জীবন’। বিয়ে ও
দাম্পত্য জীবন বিশ্বপ্রকৃতির এক স্বভাব
সম্মত বিধান। এ এক চিরন্তন ও শাশ্বত
ব্যবস্থা, যা কার্যকর হয়ে আছে বিশ্ব
প্রকৃতির পরতে পরতে, প্রত্যেকটি জীব ও
বস্তুর মধ্যে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র
কুরআনে ইরশাদ করেন- ‘প্রত্যেকটি
জিনিসকেই আমি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি
করেছি।’{সূরা ৫১ যারিয়াত, আয়াত-৪৯}
মানুষের পরিবার ও পারিবারিক জীবন
হচ্ছে সমাজ জীবনের ভিত্তি প্রস্তর। বিয়ে
ছাড়া অন্য কোন পন্থায় পরিবার ও
পারিবারিক জীবন গড়ে উঠতে পারে না।
পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম আ. ও প্রথম
মানবী হযরত হাওয়া আ.কে কেন্দ্র করে
মানব জাতির প্রথম পরিবার গড়ে উঠেছিল
জান্নাতে। এই প্রথম পরিবারের সদস্যদ্বয়
স্বামী ও স্ত্রীকে লক্ষ্য করেই মহান
আল্লাহ বলেছিলেন, ‘হে আদম, তুমি ও
তোমার স্ত্রী জান্নাতে একত্রে বসবাস কর
এবং যেখান থেকে মন চায় তোমরা দু’জনে
অবাধে পানাহার কর। কিন্তু এই বৃক্ষের
নিকটবর্তী হবে না; তাহলে তোমরা
অন্যায়কারীদের অন্তর্ভূক্ত হবে।’{সূরা
বাকারা, আয়াত-৩৫}
**- বিবাহ কেন্দ্রিক পরিবারের গুরুত্ব
বোঝাতে গিয়ে মহান আল্লাহ জান্নাতেই
আদম ও হাওয়া আ.-এর বিবাহের ব্যবস্থা
করেন। জান্নাত চির সুখের স্থান।
বাধাহীন, কষ্ট-ক্লেশহীন জীবন হল
জান্নাতী জীবন। সেই জান্নাতেও কিন্তু
বিবাহপূর্ব নারী ও পুরুষের সহঅবস্থান বৈধ
করা হয়নি এবং সেখানেও অবাধে
পানাহার করার স্বাধীনতার পাশাপাশি
একটি মাত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা
হয়েছিল। আর তা হল, একটি নির্দিষ্ট
বৃক্ষের ফল ভক্ষণের নিষেধাজ্ঞা। শুধু
মাত্র ফল ভক্ষণের নিষেধাজ্ঞাই নয়, বরং
উক্ত বৃক্ষের কাছে যেতেও নিষেধ করা
হয়েছিল।
উল্লেখিত আয়াতে ইসলামী পরিবার ও
পারিবারিক জীবনের বহু দিকনির্দেশনা
লুকিয়ে আছে। স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ
কেন্দ্রিক যে জীবন গড়ে ওঠে, তা মূলত
জান্নাতী জীবন। জান্নাতের সুখ-শান্তির
কিছুটা নমুনা বিবাহ কেন্দ্রিক বিধিবদ্ধ
শরীয়ত সম্মত জীবনের মাঝেই খুঁজে পাওয়া
যাবে। বিবাহ কেন্দ্রিক বিধিবদ্ধ শরীয়ত
সম্মত জীবন-যাপন ছাড়া দুনিয়াটাই হয়ে
উঠবে জাহান্নাম। তাই বিবাহ অনুষ্ঠান
সুন্নাত তরীকায় হওয়া উচিত। আজকাল
অধিকাংশ বিবাহে গান-বাজনা, বে-পর্দা,
অশ্লীলতা, অপচয়, যৌতুক ইত্যাদি নানা
কারণে বিবাহ নামক ইবাদতের সাওয়াব ও
বরকত থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। সঙ্গত
কারণেই দাম্পত্য জীবনের কিছু দিন যেতে
না যেতেই শুরু হয় দ্বন্দ্ব-কলহ। বিবাহ একটি
ইবাদত। তাই, মহানবী সা. বিবাহ নামক
ইবাদত মসজিদে সম্পন্ন করতে তাকিদ
দিয়েছেন। বলেছেন, ‘তোমরা বিবাহ
অনুষ্ঠানের ব্যাপক প্রচার কর এবং
সাধারণত এর অনুষ্ঠান মসজিদে সম্পন্ন
কর।’ {তিরমিযী শরীফ, হাদীস-১০০৯}
বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য ‘মহরানা’ হচ্ছে
একটি জরুরী শর্ত। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ
হয়েছে- ‘তোমরা স্ত্রীদের প্রাপ্য মহরানা
আদায় করে দাও আন্তরিক খুশির সাথে ও
তাদের অধিকার মনে করে। {সূরা ৪ নিসা,
আয়াত-৪} আজকাল অধিকাংশ স্বামী
স্ত্রীর মহরানা আদায়ের ব্যাপারে
চরমভাবে উদাসীন। মহরানা যে স্ত্রীর
অধিকার, অনেক স্বামী তা বোঝেই না।
আবার কোন কোন বিবাহে এত বেশি
পরিমানে মহরানা নির্ধারণ করা হয়, যা
স্বামীর পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব হয় না।
তারপরও শুধুমাত্র সামাজিক কারণে বা
লৌকিকতার কারণে বা কারো চাপে পড়ে
সামর্থের বাইরে মহরানা নির্ধারণ করা হয়।
অথচ হাদীস শরীফে হুজুর সা. ইরশাদ করেন,
‘সবচেয়ে উত্তম বিবাহ যাতে খরচ কম ও
সহজসাধ্য।’ {আবু দাউদ শরীফ, হাদীস-১৮০৮}
একদিকে সামর্থের বাইরে মহরানা
নির্ধারণ, আরেক দিকে যৌতুকের
অভিশাপ। স্বামী যেহেতু যৌতুক নিচ্ছে,
সম্ভবত সে কারণেই মহরানাটাও
অযৌক্তিক ও সামর্থের বাইরে নির্ধারণ
করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য হল, যদি কখনো
ছাড়াছাড়ি (তালাক) হয়ে যায়, তাহলে
আদালতের মাধ্যমে উক্ত টাকা যেন উসূল
করে নেয়া যায়। হায় আফেসোস! বিবাহের
মত একটি পবিত্র ইবাদতের শুরুতেই
অবিশ্বাসের বীজ বপন করা হচ্ছে। যে
দাম্পত্য জীবনের শুরুটাই হচ্ছে অশ্লীলতা,
গান-বাজনা, বেহায়াপনা, বে-পর্দা আর
অবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে, ঐ দাম্পত্য
জীবনে সুখ-শান্তির আশা করা যায় কি?
পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ইসলামের
দৃষ্টিতে বিশেষ একটি গুণ যাচাই করে
দেখা আবশ্যক। সে গুণটি হচ্ছে, ‘কনের
দ্বীনদার ও ধার্মিক হওয়া’। এ সম্পর্কে
রাসূল সা. ইরশাদ করেন, ‘চারটি গুণের
কারণে একটি মেয়েকে বিবাহ করার কথা
বিবেচনা করা হয়। তার ধন-সম্পদ, তার বংশ
গৌরব-সামাজিক মান-মর্যাদা, তার রূপ-
সৌন্দর্য এবং দ্বীনদারী। কিন্তু তোমরা
দ্বীনদার মেয়েকে বিবাহ করে সফলতা
অর্জন কর।’ {বুখারী শরীফ, হাদীস-৪৭০০}
উল্লেখিত হাদীসে চারটি গুণের মাঝে
সর্বশেষ গুণটাই মূখ্য। প্রথম তিনটি গুণ
বিদ্যমান থাকার পরেও যদি শেষের গুণ-
দ্বীনদারী না থাকে, তাহলে প্রথমোক্ত
তিনটি গুণ মূল্যহীন হয়ে যাবে। উল্লেখিত
হাদীসটির ভাষা অপর এক বর্ণনায় এরূপ
উদ্ধৃত হয়েছে- ‘তোমরা মেয়েদের কেবল
তাদের রূপ-সৌন্দর্য দেখেই বিয়ে করো
না। কেননা, এ রূপ-সৌন্দর্য অনেক সময়
তাদের ধ্বংসের কারণ হতে পারে। তাদের
ধন-সম্পদের লোভে পড়েও বিয়ে করবে না।
কেননা এ ধন-সম্পদ তাদের বিদ্রোহী ও
অনমনীয় বানাতে পারে। বরং তাদের
দ্বীনদারীর গুণ দেখেই তবে বিয়ে করবে।
বস্ত্তত একজন দ্বীনদার কৃষ্ণাঙ্গ দাসীও
অনেক ভাল। {ইবনে মাযাহ শরীফ,
হাদীস-১৮৪৯}
হযরত আদম ও হাওয়া আ.-এর জান্নাতে
বিবাহ ও অবাধে পানাহার করার সুযোগ
দেয়ার পরেও একটি বৃক্ষের নিকট যেতে
নিষেধ করা হয়েছিল। এতে করে বিধিবদ্ধ
জীবন-যাপনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
অর্থাৎ এই জান্নাতে চিরস্থায়ীভাবে
থাকতে চাইলে পৃথিবীতে অবতরণ করে
বিধিবদ্ধ শরীয়ত সম্মত জীবন-যাপন করে
আসতে হবে। তবেই না বাধাহীন চির সুখের
জান্নাতে প্রবেশ করা যাবে।
মুসলিম পারিবারিক জীবনের অন্যতম একটি
বৈশিষ্ট হল স্বামী-স্ত্রীর একত্রে অবস্থান
করা। স্বামী-স্ত্রীর একত্রে অবস্থান করার
ব্যাপারে স্ত্রী স্বামীর অনুগত থাকবে।
অর্থাৎ স্বামী যেখানে অবস্থান করবে,
স্ত্রীকেও সেখানেই অবস্থান করতে হবে।
কিন্তু পানাহারের ব্যাপারে উভয়ে
স্বাধীন। অর্থাৎ স্বামী যা খাবে,
স্ত্রীকেও তাই খেতে হবে, এমন
বাধ্যবাধকতা ইসলামে নেই। পবিত্র
কুরআনে স্বামী-স্ত্রীর অবস্থান করা
সংক্রান্ত বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন দু’টি বাক্য
ব্যবহার করা হয়েছে। এবং একটি বাক্যকে
অপর বাক্যের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে।
কিন্তু পানাহার সংক্রান্ত বিষয়ে একটি
বাক্যেই তা বোঝানো হয়েছে। পবিত্র
কুরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা
স্ত্রীদের সাথে খুব ভাল ব্যবহার ও সৎভাবে
বসবাস করো। তোমরা যদি তাদের অপছন্দ
কর, তাহলে হতে পারে যে, তোমরা একটা
জিনিসকে অপছন্দ করছ, অথচ আল্লাহ তার
মধ্যে বিপুল কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।
{সূরা ৪ নিসা, আয়াত-১৯}
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক দায়-দায়িত্ব,
অধিকার, কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামে
সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। স্বামী ও
স্ত্রীর মাঝে সম্পর্ক কেমন হবে, তা খুব
চমৎকারভাবে মহান আল্লাহ ঘোষণা
করেছেন, ‘স্ত্রীরা হচ্ছে তোমাদের জন্য
পোশাক স্বরূপ।’ {সূরা ২ বাকারা,
আয়াত-১৮৭} অর্থাৎ পোষাক যেমন
মানবদেহকে আবৃত করে দেয়, তার নগ্নতা ও
ও কুশ্রীতা প্রকাশ হতে দেয় না এবং সব
রকমের ক্ষতি-অপকারিতা থেকে বাঁচায়,
স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের জন্য ঠিখ তেমনি।
পোশাক যেমন দেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে,
তদ্রুপ স্বামী-স্ত্রীও পরস্পরের সৌন্দর্য
বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট থাকবে। পোশাক যেমন
দেহের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে লেগে
থাকে, তদ্রুপ স্বামী-স্ত্রীও একে অপরের
সুখে-দুখে অঙ্গাঙ্গিভাবে লেগে থাকবে।
মহান আল্লাহ পারিবারিক জীবনের
মধুময়তা প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন, ‘এবং
আল্লাহর একটি বড় নিদর্শন এই যে, তিনি
তোমাদের মধ্য থেকে সঙ্গীনি গ্রহণের
ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যেন তোমরা সে
সঙ্গীনির কাছ থেকে পরম পরিতৃপ্তি লাভ
করতে পার। আর তোমাদের মাঝে তিনি
প্রেম-ভালবাসা, দরদ-মায়া ও প্রীতি-প্রণয়
সৃষ্টি করে দিয়েছেন। {সূরা রূম, আয়াত-২১}
পরিবার ও পারিবারিক জীবনে ইসলামী
অনুশাসন না থাকলে উল্লেখিত প্রেম-
ভালবাসা, দরদ-মায়া এগুলো কিছুই
অবশিষ্ট থাকবে না। বরং দ্বন্দ্ব-কলহ,
সন্দেহ, অমিল-অশান্তি- এগুলো বাসা
বেঁধে স্বাভাবিক জীবনকে দুর্বিষহ করে
তুলবে। বিশেষ করে বর্তমানে
স্যাটেলাইটের যুগে অপসংস্কৃতির সয়লাবে
আমাদের পারিবারিক জীবন হুমকির মুখে
পতিত হয়েছে। স্যাটেলাইটে প্রদর্শিত
উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনা আমাদের সমাজ
জীবনকে কলুষিত করে তুলছে। হত্যা-
ব্যভিচার ইত্যাদি এখন নিত্য নৈমিত্তিক
ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। আমাদের
পোশাক-আশাকেও এসেছে উলঙ্গপনার
ছাপ। বয়ফ্রেন্ড ও গার্লফ্রেন্ডের সংস্কৃতি
এখন আমাদের দেশেও চালু হতে শুরু
করেছে। ‘ফাদার ডে’ আর ‘মাদার ডে’
পালন করে পরিবার ও পারিবারিক জীবনে
সুখ আসবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের
পরিবার ও পারিবারিক জীবনে সুন্নাতে
নববী সা.-এর পূর্ণাঙ্গ অনুশাসন আমরা
মেনে চলব। আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে
পরিবার থেকেই সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা,
সত্যবাদিতা, পরস্পরে শ্রদ্ধাবোধ, আদব-
কায়দা তথা ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত
করে তুলতে হবে। সাত বছর বয়স থেকেই
নামাযের শিক্ষা, দশ বছর হলে নামায না
পড়লে শাস্তির ব্যবস্থা করা, কুরআন
তিলাওয়াত শিক্ষা দেয়া, ইত্যাদির প্রতি
অধিক তাকিদ দিতে হবে। অন্যথায়
আমাদের পারিবারিক জীবন অশান্তিময়
হয়ে উঠবে। পরিবারই হল মৌলিক
বিদ্যাপীঠ। এখান থেকেই সুশিক্ষার সূচনা
করতে হবে। আর এই সুশিক্ষা কুরআন ও
হাদীসের শিক্ষা গ্রহণ করা ছাড়া অন্য
কোন ভাবেই সম্ভব নয়। এ জন্যেই রাসূল সা.
ইরশাদ করেছেন, ‘ইলম (কুরআন হাদীসের
জ্ঞান) অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের
(নারী-পুরুষ) উপর ফরজ।’ {ইবনে মাযাহ,
হাদীস-২২০}
আজ আমরা শুধু উপার্জনমুখী বিদ্যা
শিখতে আগ্রহী বেশি। মানবতামুখী বিদ্যা
শিখতে আমাদের কোন তৎপরতাই লক্ষ্য
করা যায় না। আল্লাহ তাআলা
আমাদেরকে হেফাযত করুন। আমীন।
আবদ্ধ হয়ে যখন একসঙ্গে জীবন যাপন
করতে শুরু করে, তখনই একটি পরিবারের
ভিত্তি স্থাপিত হয়। এখানে পুরুষকে স্বামী
আর নারীকে স্ত্রী বলা হয়। এ দু’য়ের
সম্মিলিত ভালবাসাপূর্ণ সামগ্রিক
জীবনকেই বলা হয় ‘দাম্পত্য জীবন’। বিয়ে ও
দাম্পত্য জীবন বিশ্বপ্রকৃতির এক স্বভাব
সম্মত বিধান। এ এক চিরন্তন ও শাশ্বত
ব্যবস্থা, যা কার্যকর হয়ে আছে বিশ্ব
প্রকৃতির পরতে পরতে, প্রত্যেকটি জীব ও
বস্তুর মধ্যে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র
কুরআনে ইরশাদ করেন- ‘প্রত্যেকটি
জিনিসকেই আমি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি
করেছি।’{সূরা ৫১ যারিয়াত, আয়াত-৪৯}
মানুষের পরিবার ও পারিবারিক জীবন
হচ্ছে সমাজ জীবনের ভিত্তি প্রস্তর। বিয়ে
ছাড়া অন্য কোন পন্থায় পরিবার ও
পারিবারিক জীবন গড়ে উঠতে পারে না।
পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম আ. ও প্রথম
মানবী হযরত হাওয়া আ.কে কেন্দ্র করে
মানব জাতির প্রথম পরিবার গড়ে উঠেছিল
জান্নাতে। এই প্রথম পরিবারের সদস্যদ্বয়
স্বামী ও স্ত্রীকে লক্ষ্য করেই মহান
আল্লাহ বলেছিলেন, ‘হে আদম, তুমি ও
তোমার স্ত্রী জান্নাতে একত্রে বসবাস কর
এবং যেখান থেকে মন চায় তোমরা দু’জনে
অবাধে পানাহার কর। কিন্তু এই বৃক্ষের
নিকটবর্তী হবে না; তাহলে তোমরা
অন্যায়কারীদের অন্তর্ভূক্ত হবে।’{সূরা
বাকারা, আয়াত-৩৫}
**- বিবাহ কেন্দ্রিক পরিবারের গুরুত্ব
বোঝাতে গিয়ে মহান আল্লাহ জান্নাতেই
আদম ও হাওয়া আ.-এর বিবাহের ব্যবস্থা
করেন। জান্নাত চির সুখের স্থান।
বাধাহীন, কষ্ট-ক্লেশহীন জীবন হল
জান্নাতী জীবন। সেই জান্নাতেও কিন্তু
বিবাহপূর্ব নারী ও পুরুষের সহঅবস্থান বৈধ
করা হয়নি এবং সেখানেও অবাধে
পানাহার করার স্বাধীনতার পাশাপাশি
একটি মাত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা
হয়েছিল। আর তা হল, একটি নির্দিষ্ট
বৃক্ষের ফল ভক্ষণের নিষেধাজ্ঞা। শুধু
মাত্র ফল ভক্ষণের নিষেধাজ্ঞাই নয়, বরং
উক্ত বৃক্ষের কাছে যেতেও নিষেধ করা
হয়েছিল।
উল্লেখিত আয়াতে ইসলামী পরিবার ও
পারিবারিক জীবনের বহু দিকনির্দেশনা
লুকিয়ে আছে। স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ
কেন্দ্রিক যে জীবন গড়ে ওঠে, তা মূলত
জান্নাতী জীবন। জান্নাতের সুখ-শান্তির
কিছুটা নমুনা বিবাহ কেন্দ্রিক বিধিবদ্ধ
শরীয়ত সম্মত জীবনের মাঝেই খুঁজে পাওয়া
যাবে। বিবাহ কেন্দ্রিক বিধিবদ্ধ শরীয়ত
সম্মত জীবন-যাপন ছাড়া দুনিয়াটাই হয়ে
উঠবে জাহান্নাম। তাই বিবাহ অনুষ্ঠান
সুন্নাত তরীকায় হওয়া উচিত। আজকাল
অধিকাংশ বিবাহে গান-বাজনা, বে-পর্দা,
অশ্লীলতা, অপচয়, যৌতুক ইত্যাদি নানা
কারণে বিবাহ নামক ইবাদতের সাওয়াব ও
বরকত থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। সঙ্গত
কারণেই দাম্পত্য জীবনের কিছু দিন যেতে
না যেতেই শুরু হয় দ্বন্দ্ব-কলহ। বিবাহ একটি
ইবাদত। তাই, মহানবী সা. বিবাহ নামক
ইবাদত মসজিদে সম্পন্ন করতে তাকিদ
দিয়েছেন। বলেছেন, ‘তোমরা বিবাহ
অনুষ্ঠানের ব্যাপক প্রচার কর এবং
সাধারণত এর অনুষ্ঠান মসজিদে সম্পন্ন
কর।’ {তিরমিযী শরীফ, হাদীস-১০০৯}
বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য ‘মহরানা’ হচ্ছে
একটি জরুরী শর্ত। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ
হয়েছে- ‘তোমরা স্ত্রীদের প্রাপ্য মহরানা
আদায় করে দাও আন্তরিক খুশির সাথে ও
তাদের অধিকার মনে করে। {সূরা ৪ নিসা,
আয়াত-৪} আজকাল অধিকাংশ স্বামী
স্ত্রীর মহরানা আদায়ের ব্যাপারে
চরমভাবে উদাসীন। মহরানা যে স্ত্রীর
অধিকার, অনেক স্বামী তা বোঝেই না।
আবার কোন কোন বিবাহে এত বেশি
পরিমানে মহরানা নির্ধারণ করা হয়, যা
স্বামীর পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব হয় না।
তারপরও শুধুমাত্র সামাজিক কারণে বা
লৌকিকতার কারণে বা কারো চাপে পড়ে
সামর্থের বাইরে মহরানা নির্ধারণ করা হয়।
অথচ হাদীস শরীফে হুজুর সা. ইরশাদ করেন,
‘সবচেয়ে উত্তম বিবাহ যাতে খরচ কম ও
সহজসাধ্য।’ {আবু দাউদ শরীফ, হাদীস-১৮০৮}
একদিকে সামর্থের বাইরে মহরানা
নির্ধারণ, আরেক দিকে যৌতুকের
অভিশাপ। স্বামী যেহেতু যৌতুক নিচ্ছে,
সম্ভবত সে কারণেই মহরানাটাও
অযৌক্তিক ও সামর্থের বাইরে নির্ধারণ
করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য হল, যদি কখনো
ছাড়াছাড়ি (তালাক) হয়ে যায়, তাহলে
আদালতের মাধ্যমে উক্ত টাকা যেন উসূল
করে নেয়া যায়। হায় আফেসোস! বিবাহের
মত একটি পবিত্র ইবাদতের শুরুতেই
অবিশ্বাসের বীজ বপন করা হচ্ছে। যে
দাম্পত্য জীবনের শুরুটাই হচ্ছে অশ্লীলতা,
গান-বাজনা, বেহায়াপনা, বে-পর্দা আর
অবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে, ঐ দাম্পত্য
জীবনে সুখ-শান্তির আশা করা যায় কি?
পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ইসলামের
দৃষ্টিতে বিশেষ একটি গুণ যাচাই করে
দেখা আবশ্যক। সে গুণটি হচ্ছে, ‘কনের
দ্বীনদার ও ধার্মিক হওয়া’। এ সম্পর্কে
রাসূল সা. ইরশাদ করেন, ‘চারটি গুণের
কারণে একটি মেয়েকে বিবাহ করার কথা
বিবেচনা করা হয়। তার ধন-সম্পদ, তার বংশ
গৌরব-সামাজিক মান-মর্যাদা, তার রূপ-
সৌন্দর্য এবং দ্বীনদারী। কিন্তু তোমরা
দ্বীনদার মেয়েকে বিবাহ করে সফলতা
অর্জন কর।’ {বুখারী শরীফ, হাদীস-৪৭০০}
উল্লেখিত হাদীসে চারটি গুণের মাঝে
সর্বশেষ গুণটাই মূখ্য। প্রথম তিনটি গুণ
বিদ্যমান থাকার পরেও যদি শেষের গুণ-
দ্বীনদারী না থাকে, তাহলে প্রথমোক্ত
তিনটি গুণ মূল্যহীন হয়ে যাবে। উল্লেখিত
হাদীসটির ভাষা অপর এক বর্ণনায় এরূপ
উদ্ধৃত হয়েছে- ‘তোমরা মেয়েদের কেবল
তাদের রূপ-সৌন্দর্য দেখেই বিয়ে করো
না। কেননা, এ রূপ-সৌন্দর্য অনেক সময়
তাদের ধ্বংসের কারণ হতে পারে। তাদের
ধন-সম্পদের লোভে পড়েও বিয়ে করবে না।
কেননা এ ধন-সম্পদ তাদের বিদ্রোহী ও
অনমনীয় বানাতে পারে। বরং তাদের
দ্বীনদারীর গুণ দেখেই তবে বিয়ে করবে।
বস্ত্তত একজন দ্বীনদার কৃষ্ণাঙ্গ দাসীও
অনেক ভাল। {ইবনে মাযাহ শরীফ,
হাদীস-১৮৪৯}
হযরত আদম ও হাওয়া আ.-এর জান্নাতে
বিবাহ ও অবাধে পানাহার করার সুযোগ
দেয়ার পরেও একটি বৃক্ষের নিকট যেতে
নিষেধ করা হয়েছিল। এতে করে বিধিবদ্ধ
জীবন-যাপনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
অর্থাৎ এই জান্নাতে চিরস্থায়ীভাবে
থাকতে চাইলে পৃথিবীতে অবতরণ করে
বিধিবদ্ধ শরীয়ত সম্মত জীবন-যাপন করে
আসতে হবে। তবেই না বাধাহীন চির সুখের
জান্নাতে প্রবেশ করা যাবে।
মুসলিম পারিবারিক জীবনের অন্যতম একটি
বৈশিষ্ট হল স্বামী-স্ত্রীর একত্রে অবস্থান
করা। স্বামী-স্ত্রীর একত্রে অবস্থান করার
ব্যাপারে স্ত্রী স্বামীর অনুগত থাকবে।
অর্থাৎ স্বামী যেখানে অবস্থান করবে,
স্ত্রীকেও সেখানেই অবস্থান করতে হবে।
কিন্তু পানাহারের ব্যাপারে উভয়ে
স্বাধীন। অর্থাৎ স্বামী যা খাবে,
স্ত্রীকেও তাই খেতে হবে, এমন
বাধ্যবাধকতা ইসলামে নেই। পবিত্র
কুরআনে স্বামী-স্ত্রীর অবস্থান করা
সংক্রান্ত বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন দু’টি বাক্য
ব্যবহার করা হয়েছে। এবং একটি বাক্যকে
অপর বাক্যের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে।
কিন্তু পানাহার সংক্রান্ত বিষয়ে একটি
বাক্যেই তা বোঝানো হয়েছে। পবিত্র
কুরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা
স্ত্রীদের সাথে খুব ভাল ব্যবহার ও সৎভাবে
বসবাস করো। তোমরা যদি তাদের অপছন্দ
কর, তাহলে হতে পারে যে, তোমরা একটা
জিনিসকে অপছন্দ করছ, অথচ আল্লাহ তার
মধ্যে বিপুল কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।
{সূরা ৪ নিসা, আয়াত-১৯}
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক দায়-দায়িত্ব,
অধিকার, কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামে
সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। স্বামী ও
স্ত্রীর মাঝে সম্পর্ক কেমন হবে, তা খুব
চমৎকারভাবে মহান আল্লাহ ঘোষণা
করেছেন, ‘স্ত্রীরা হচ্ছে তোমাদের জন্য
পোশাক স্বরূপ।’ {সূরা ২ বাকারা,
আয়াত-১৮৭} অর্থাৎ পোষাক যেমন
মানবদেহকে আবৃত করে দেয়, তার নগ্নতা ও
ও কুশ্রীতা প্রকাশ হতে দেয় না এবং সব
রকমের ক্ষতি-অপকারিতা থেকে বাঁচায়,
স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের জন্য ঠিখ তেমনি।
পোশাক যেমন দেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে,
তদ্রুপ স্বামী-স্ত্রীও পরস্পরের সৌন্দর্য
বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট থাকবে। পোশাক যেমন
দেহের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে লেগে
থাকে, তদ্রুপ স্বামী-স্ত্রীও একে অপরের
সুখে-দুখে অঙ্গাঙ্গিভাবে লেগে থাকবে।
মহান আল্লাহ পারিবারিক জীবনের
মধুময়তা প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন, ‘এবং
আল্লাহর একটি বড় নিদর্শন এই যে, তিনি
তোমাদের মধ্য থেকে সঙ্গীনি গ্রহণের
ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যেন তোমরা সে
সঙ্গীনির কাছ থেকে পরম পরিতৃপ্তি লাভ
করতে পার। আর তোমাদের মাঝে তিনি
প্রেম-ভালবাসা, দরদ-মায়া ও প্রীতি-প্রণয়
সৃষ্টি করে দিয়েছেন। {সূরা রূম, আয়াত-২১}
পরিবার ও পারিবারিক জীবনে ইসলামী
অনুশাসন না থাকলে উল্লেখিত প্রেম-
ভালবাসা, দরদ-মায়া এগুলো কিছুই
অবশিষ্ট থাকবে না। বরং দ্বন্দ্ব-কলহ,
সন্দেহ, অমিল-অশান্তি- এগুলো বাসা
বেঁধে স্বাভাবিক জীবনকে দুর্বিষহ করে
তুলবে। বিশেষ করে বর্তমানে
স্যাটেলাইটের যুগে অপসংস্কৃতির সয়লাবে
আমাদের পারিবারিক জীবন হুমকির মুখে
পতিত হয়েছে। স্যাটেলাইটে প্রদর্শিত
উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনা আমাদের সমাজ
জীবনকে কলুষিত করে তুলছে। হত্যা-
ব্যভিচার ইত্যাদি এখন নিত্য নৈমিত্তিক
ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। আমাদের
পোশাক-আশাকেও এসেছে উলঙ্গপনার
ছাপ। বয়ফ্রেন্ড ও গার্লফ্রেন্ডের সংস্কৃতি
এখন আমাদের দেশেও চালু হতে শুরু
করেছে। ‘ফাদার ডে’ আর ‘মাদার ডে’
পালন করে পরিবার ও পারিবারিক জীবনে
সুখ আসবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের
পরিবার ও পারিবারিক জীবনে সুন্নাতে
নববী সা.-এর পূর্ণাঙ্গ অনুশাসন আমরা
মেনে চলব। আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে
পরিবার থেকেই সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা,
সত্যবাদিতা, পরস্পরে শ্রদ্ধাবোধ, আদব-
কায়দা তথা ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত
করে তুলতে হবে। সাত বছর বয়স থেকেই
নামাযের শিক্ষা, দশ বছর হলে নামায না
পড়লে শাস্তির ব্যবস্থা করা, কুরআন
তিলাওয়াত শিক্ষা দেয়া, ইত্যাদির প্রতি
অধিক তাকিদ দিতে হবে। অন্যথায়
আমাদের পারিবারিক জীবন অশান্তিময়
হয়ে উঠবে। পরিবারই হল মৌলিক
বিদ্যাপীঠ। এখান থেকেই সুশিক্ষার সূচনা
করতে হবে। আর এই সুশিক্ষা কুরআন ও
হাদীসের শিক্ষা গ্রহণ করা ছাড়া অন্য
কোন ভাবেই সম্ভব নয়। এ জন্যেই রাসূল সা.
ইরশাদ করেছেন, ‘ইলম (কুরআন হাদীসের
জ্ঞান) অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের
(নারী-পুরুষ) উপর ফরজ।’ {ইবনে মাযাহ,
হাদীস-২২০}
আজ আমরা শুধু উপার্জনমুখী বিদ্যা
শিখতে আগ্রহী বেশি। মানবতামুখী বিদ্যা
শিখতে আমাদের কোন তৎপরতাই লক্ষ্য
করা যায় না। আল্লাহ তাআলা
আমাদেরকে হেফাযত করুন। আমীন।
Comments
Post a Comment