বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে নারীর প্রতি অন্যায় আচরণ কি কাল্পনিক কথাবার্তা? ভিন্নচোখে দেখা কিছু মুক্ত আলোচনা।
বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে নারীর প্রতি অন্যায় আচরণ কি কাল্পনিক কথাবার্তা? ভিন্নচোখে দেখা কিছু মুক্ত আলোচনা।

নারী নিয়ে যত কথা হয় সমাজে, পত্রিকায়, টক-শো,
সেমিনারে যত লোকের, যতটা সময়ে -- তার
ক্বচিৎ-কদাচিত যদি পরিবর্তনের প্রতি সত্যিকারের
কাজ করত তাহলে সত্যিই অনেককিছু বদলে যেত
বলে আমার ধারণা। বিষয়টা স্পর্শকাতর, সত্যিকারের
সমস্যার। মুসলিম সমাজের নারীর অবস্থান নিয়ে
সম্ভবত পাশ্চাত্য বা বাংলাদেশি ইসলামবিদ্বেষী
সেক্যুলাররা বা অমুসলিমরা যত কথা বলেছে -- খুব
কমই এই সমাজের ভিতরের মানুষ থেকে
এসেছে।
কথা অনেক হয়। মুসলিম নারীরা যখন কিছু
লেখালেখি শিখে তারাও বলে। অধিকাংশ সময়
ভুক্তভোগী হওয়ায় ভাষার নখর মোটামুটি
পুরুষবিদ্বেষ পর্যায়ে যায়। লেখার আগাগোড়া পড়ার
পরে আমার অনেকবার মনে হয়েছে -- এই মহিলা
না লিখতে বসলেই বরং নারীর উপকার হত। মুসলিম
পরিচয়ের আদর্শিক অনুভূতি থেকে এবং সমস্যা
বুঝে তার সমাধানে "পুরুষবিদ্বেষ" অবস্থান থেকে
বেরিয়ে লিখতে দেখিনি অনেক উচ্চশিক্ষিত মুসলিম
ফেমিনিস্টদেরকেও। কারণ আমি নিজেই বুঝি,
পুরুষসত্ত্বার প্রতি আক্রমণ করে সমস্যা
দূরীকরণে পুরুষের সাহায্য কীভাবে পাবে
নারীরা? সমাজে/পৃথিবীতে অর্ধেকখানি পুরুষ।
নারীর সমস্যাগুলোর অনেকটাই পুরুষ থেকেই
সৃষ্টি।
ফেমিনিজম তথা নারীবাদী আইডিয়াটাও একটা মজার
ব্যাপার। সেটা গড়েই উঠেছে পুরুষদের বিরুদ্ধে
একটি "রি-অ্যাকটিভ" অ্যাপ্রোচ হিসেবে। মোটা
দাগে মোটামুটি গোটা পুরুষদের বিরুদ্ধেই
বিদ্বেষপ্রসূত যে চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠে, তাতে
কীইবা আর কল্যাণ থাকবে। এটা তো জানা কথা যে,
প্রো-অ্যাকটিভ অ্যাপ্রোচেই কল্যাণ থাকে, রি-
অ্যাকটিভ কাজে থাকে না। তাই খুব মোটা দাগেই এই
নারীবাদীতার অসারতা টের পাওয়া যায়। আজ পর্যন্ত
এই ফেমিনিস্ট অ্যাপ্রোচ উল্লেখযোগ্য কোন
সফলতা আনতে পেরেছে বলে বোঝা যায় না
সমাজের দিকে তাকিয়ে।
যাহোক, সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধান রাতারাতি হবে না,
হবার প্রশ্নই উঠে না। গোটা ব্যাপারটা শত শত বছর
ধরে গড়ে উঠেছে। মুসলিম সমাজে নারীর
সবকিছু নিয়ে কথা বলেছে বাইরের মানুষরাই বেশি।
সেকথা একটু আগেই বলেছি। নিঃসন্দেহে
ভুক্তভোগী মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে
নারীদেরকে শিক্ষিত হবার জন্য চেষ্টা করা উচিৎ
ছিলো। বিষয়টা কঠিন, বিষয়টা আসলেই কঠিন। কিন্তু
এটাই পথ। এর তুলনাটা অনেকটা এমন যে, একটা বিশাল
অট্টালিকা হবার জন্য হয়ত কোন জায়গা বিরান পড়ে
ছিলো। কারো অনেক প্রয়োজন ছিলো একটা
বাড়ি, কিন্তু তার সেখানে থাকা হলো না। তিনি যদি
এটাকে গড়ে না তোলেন সময় নিয়ে (যে
সময়ে তিনি সেখানে আরাম করে থাকতে
পারতেন) তাহলে পরের প্রজন্মও আর সেখানে
থাকতে পারবে না। তারা আরো বড় সমস্যায় পড়বে।
আমার কাছে বেশ কিছু বিষয়কে সমস্যার মনে
হয়েছে। সেগুলোর কারণগুলোও ভিন্ন, সমাধানও
অনেক আলোচনাসাপেক্ষ। তার মাঝে কিছু সমস্যা
হলো --
প্রথমত, সমাজে এখনো অনেক মেয়েই
মনে করে বিয়ের পরে তো অশান্তি আর
কষ্টে সব ভরপুর, এখন যদি একটু মজা করে না
নিই তাহলে আর লাইফে কখনো আনন্দ হবে
না। তাই তারা বেশ ছেলেবন্ধুর দলেও যায়,
এলোমেলো অজস্র কাজ করে যা হয়ত মজার
নামে। কখনই সেগুলো ভবিষ্যত জীবনে শান্তি
আনে না, কেননা এইসব করতে গিয়ে অজস্র
জটিলতায় একটা মেয়ের জীবন আটকে যায়।
অনেক ঘটনা হয়, রটনা হয় -- এগুলো থেকে
কেউ বের হতে পারে না। এর পেছনে পুরুষের
ভূমিকা আছে। বড় ভূমিকা। তা হলো, পুরুষদের মাঝে
নারীর প্রতি সম্মানের বিশাল অভাব। এটা মূলত
পারিবারিক ক্ষেত্রেই শুরু হয়, সামাজিকীকরণের
সময়ে তা প্রলম্বিত হয়।
বেশিরভাগ ছেলে সারাজীবন বড় হয় নারীকে
কেবল ভোগ করার, আনন্দ করার উপযোগী অংশ
হিসেবে। ফ্রেন্ড সার্কেলে কমবেশি সবাই
নারীর শরীর নিয়ে আলাপ করে, আলাপ করে
সৌন্দর্য নিয়ে, "মাল" টাইপের শব্দ দিয়ে সম্বোধন
করে অবলীলায়। এমনটাই কালচার ম্যাক্সিমাম
ফ্রেন্ড সার্কেলের। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায়
নারীর পোশাক স্বল্প করে করে প্রতিটি
বিলবোর্ডে আর কমার্শিয়ালে তাকে পণ্যে
রূপান্তরিত করা হয়েছে। অথচ নারীরা মা, নারীরা
বোন, নারীরা স্ত্রীর মতন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
সম্পর্ক ও দায়িত্ব পালন করছেন -- তার স্বীকৃতি ও
প্রচারণা ও সচেতনতা খুব কমই প্রজন্মের পুরুষ তথা
নারীদেরও উপলব্ধিতে পড়ে। নব্য প্রজন্মের
নারীরাও অপর নারীদের গালাগালি করে অশ্রাব্য
ভাষায় -- নষ্ট সংস্কৃতির পুরুষদের সমান স্মার্ট হবার
দাসত্ব মনোভাব তাদের টেনে কোথায় নিয়ে
গেছে। সেই ভোগবাদী সমাজে ছেলেরা
নারীর যে সম্মান, মানসিক প্রয়োজন,
অধিকারগুলো প্রতি খেয়াল রাখা যে একটা বিষয় সে
বিষয়ে তার তেমন জানাই হয় না, ভেবেও
দেখেনা। এই শিক্ষার অভাবের পেছনে যেমন
তার বাবা নামের পুরুষটি কাজ করেনি, মা নামের
নারীটিরও ভূমিকা থাকে না।
এক বা একাধিক প্রজন্মে কিছু নারীকে এগিয়ে
আসতেই হবে যারা বর্তমানের সাফারিং তথা
যন্ত্রণাগুলোকে সহ্য করবেন এবং শিক্ষা দিয়ে,
প্রচুর পরিমাণে কাজ করে আরো নতুন অনেক
খোঁটা-বাঁকা কথা ও যন্ত্রণা সহ্য করে হলেও
সমাজে নারীর প্রতি মানসিকতার উন্নয়নে কাজ
করবেন। এখানে মুখে কথার চাইতে কাজের
প্রয়োজনীয়তা অত্যাধিক।
দ্বিতীয়ত, আমার কাছে মনে হয়েছে, একটা
সমাজে নীতিহীনতা, কদর্যতা আর অন্যায় ও
অশ্লীলতার যতই প্রসার হবে -- মূলত নারীর
যন্ত্রণা ও অত্যাচার ক্রমাগত বাড়বে। নিঃসন্দেহে
সমাজের সবাইই একটি খারাপ পরিস্থিতির ভুক্তভোগী
হবে। কিন্তু সেটা পুরুষের তুলনায় নারীর জন্য
সীমাহীন যন্ত্রণাদায়ক ও খারাপ হয়। অন্তত সেটা
মাতৃত্বসুলভ অনুভূতি আর মনের কারণেই হোক বা
শারীরিক ও মানসিক কোমলতার কারণেই হোক।
কল্যাণ যারা বুঝেন, সেসব চিন্তাবিদগণ নারীদের
প্রচন্ড অনুপ্রেরণা দেন এগিয়ে আসার জন্য।
সন্তান হয়েছে, শারীরিকভাবে হয়ত কিছুটা দুর্বল ও
পারিবারিক জটিলতাও তৈরি হয়েছে -- কিন্তু পড়াশোনায়
এগিয়ে আসা উচিৎ। মুসলিম নারীরা স্বেচ্ছাচারী
হতে পারে না। স্বেচ্ছাচারিতা মুসলিমের কোন
চরিত্র নয়। কিন্তু জটিলতা নিরসনে নারীদেরই কথা
বলতে হবে এবং তাদের এই সমাজের অংশ হতে
হবে। এই সমাজের মুসলিম মানসিকতাকে তাদের
বুঝতে হবে।
তৃতীয়ত, জোর করে মেয়েদের বিয়ে
দেয়াটা কখনই ইসলামিক নয়। এই বিষয়টা বাংলাদেশের
সমাজে মাত্রাতিরিক্ত রকমের প্রসার পেয়েছে।
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করা মেয়ে, ডাক্তার
ইঞ্জিনিয়ার মেয়েরাও মা-বাবার জোরাজুরিতে বিয়ে
করতে বাধ্য হয় এমন কাউকে যাদের প্রতি তার
বিশ্বাস ও সম্মান তৈরি হয়নি, মুগ্ধতাও না। একটা যথেষ্ট
বড় হয়ে যাওয়া (বা কম বয়স হলে তো কথাই নেই)
মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেয়ার এই
কালচারের কারণে সেই মেয়েটির অনাগত
জীবনকে নিঃসন্দেহে ভোগান্তির জীবন
হিসেবে শুরু করে দেয়া হয়।
চতুর্থত, নারীর গায়ে হাত তোলার একটি সংস্কৃতি
অজস্র মুসলিম পরিবারেও বিদ্যমান (ধর্মীয়
আদর্শবিহীন পরিবারে তো আছেই) এবং এটা
অস্বীকার করার উপায় নেই। এই বিষয় অস্বীকার
করে অনেকে ধামাচাপা দিতে চান বা বিভিন্ন দলীল
এনে এটাকে নির্লজ্জভাবে চালিয়ে দিতে চান।
অথচ সচরাচর পরিবারগুলোতে অবলীলায়
মেয়েদের গায়ে হাত তোলা হয়, বাপের বাড়িতে
পাঠিয়ে দেয়ার ভয় দেখানো হয়। একটি সংসার কখনই
একটি পুরুষের একার নয়, আল্লাহর কাছে প্রতিটা
মানুষের অবস্থান একসমান। সে এই কাজটি করার
অধিকার রাখে না, সেটা না বুঝতে চাওয়ার জন্য
আল্লাহভীতিহীন অহংসম্পন্ন মুসলিম হতে হয়
কেবল।
পঞ্চমত, এখনো বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে
উত্তরাধিকার ও সম্পত্তি ভাগাভাগিতে আল্লাহভীতির
চিহ্নও নাই। সরকার আধা-আধা টাইপের অ-ইসলামিক
নীতি চাপিয়ে কেবল ইসলামকেই অবজ্ঞা
করেছে যা মূলত প্রকৃত পরিস্থিতিকে ঘোলাটে
করেছে। পরিবারে ভাইয়েরা যখন বোনকে
অবজ্ঞা ও অবহেলা করে সম্পদের বন্টন
থেকে বঞ্চিত করে -- সেখানে আইনের
ঝামেলা করে সম্পর্কটাকে থানা-পুলিশ-সালিশে সমাধান
হয় না। এখানে অনেক বেশি দরকার ছিল ইমাম-মুফতি
এবং মুসলিম মনের মাঝে পরিবর্তন।
সমস্যাগুলো দেখে একটা বিষয় আমার মাঝে
বারবার মনে হয়েছে। এখানে মুসলিম মনের
পরিবর্তনই আবশ্যক। নারীরা ভুক্তভোগী মন
আর কষ্ট নিয়ে বসে থাকলে কখনই সমাধান
আসবে না -- বরং নিজেদেরকে এগিয়ে
আসতে হবে ইসলামের শিক্ষায়। নারীবাদিতার
তীর্যক পুরুষবিদ্বেষ মানসিকতা থেকে নয় বরং
ইসলামের আদল তথা ন্যায় বিচার, ইহসান, সৎব্যবহার,
সঠিক অধিকারকে নিশ্চিত করার মানসিকতা থেকেই
এইসব ইসলামিক বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে
নারীদেরকে।
ভুগতে ভুগতে মা-খালা, নানী-দাদীরা চোখের পানি
ফেলেই জীবন পেরিয়ে গেছেন। এমনও নয়
যে তাদের সঙ্গী পুরুষেরাও অনেক সুখে
থেকেছেন। হয়ত বিভিন্ন মারপ্যাঁচে পড়ে কষ্ট
এবং যন্ত্রণা নারীদেরকেই আষ্টেপৃষ্ঠে
বেঁধেছে। এখন যারা যে বয়সেই আছেন,
এগিয়ে আসা উচিৎ জ্ঞানার্জনে। শিক্ষার্জনের বয়স
নেই। অনেক মহিলা দেখেছি যারা ৩০/৩৫ বছরে
সন্তান কোলে নিয়ে পড়েছেন। এমন ঘটনা
আশেপাশেই আছে। তবে, পরিবর্তনে এগিয়ে না
আসলে কিছু বদলাবে না। আল্লাহর পৃথিবীতে,
আল্লাহর সৃষ্টি মানুষদের মাঝে আদল, ইহসান প্রতিষ্ঠা
করতে নারীর ভূমিকা যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,
তেমনি পুরুষেরও। নইলে, কিয়ামাতের দিন জবাবদিহিতা
যে পুরুষ বা নারী কারো জন্যই সহজ হবে না ,
সেই বিষয়ে হলফ করে বলে দেয়া যায়।
লিখেছেন - সাফওয়ান

নারী নিয়ে যত কথা হয় সমাজে, পত্রিকায়, টক-শো,
সেমিনারে যত লোকের, যতটা সময়ে -- তার
ক্বচিৎ-কদাচিত যদি পরিবর্তনের প্রতি সত্যিকারের
কাজ করত তাহলে সত্যিই অনেককিছু বদলে যেত
বলে আমার ধারণা। বিষয়টা স্পর্শকাতর, সত্যিকারের
সমস্যার। মুসলিম সমাজের নারীর অবস্থান নিয়ে
সম্ভবত পাশ্চাত্য বা বাংলাদেশি ইসলামবিদ্বেষী
সেক্যুলাররা বা অমুসলিমরা যত কথা বলেছে -- খুব
কমই এই সমাজের ভিতরের মানুষ থেকে
এসেছে।
কথা অনেক হয়। মুসলিম নারীরা যখন কিছু
লেখালেখি শিখে তারাও বলে। অধিকাংশ সময়
ভুক্তভোগী হওয়ায় ভাষার নখর মোটামুটি
পুরুষবিদ্বেষ পর্যায়ে যায়। লেখার আগাগোড়া পড়ার
পরে আমার অনেকবার মনে হয়েছে -- এই মহিলা
না লিখতে বসলেই বরং নারীর উপকার হত। মুসলিম
পরিচয়ের আদর্শিক অনুভূতি থেকে এবং সমস্যা
বুঝে তার সমাধানে "পুরুষবিদ্বেষ" অবস্থান থেকে
বেরিয়ে লিখতে দেখিনি অনেক উচ্চশিক্ষিত মুসলিম
ফেমিনিস্টদেরকেও। কারণ আমি নিজেই বুঝি,
পুরুষসত্ত্বার প্রতি আক্রমণ করে সমস্যা
দূরীকরণে পুরুষের সাহায্য কীভাবে পাবে
নারীরা? সমাজে/পৃথিবীতে অর্ধেকখানি পুরুষ।
নারীর সমস্যাগুলোর অনেকটাই পুরুষ থেকেই
সৃষ্টি।
ফেমিনিজম তথা নারীবাদী আইডিয়াটাও একটা মজার
ব্যাপার। সেটা গড়েই উঠেছে পুরুষদের বিরুদ্ধে
একটি "রি-অ্যাকটিভ" অ্যাপ্রোচ হিসেবে। মোটা
দাগে মোটামুটি গোটা পুরুষদের বিরুদ্ধেই
বিদ্বেষপ্রসূত যে চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠে, তাতে
কীইবা আর কল্যাণ থাকবে। এটা তো জানা কথা যে,
প্রো-অ্যাকটিভ অ্যাপ্রোচেই কল্যাণ থাকে, রি-
অ্যাকটিভ কাজে থাকে না। তাই খুব মোটা দাগেই এই
নারীবাদীতার অসারতা টের পাওয়া যায়। আজ পর্যন্ত
এই ফেমিনিস্ট অ্যাপ্রোচ উল্লেখযোগ্য কোন
সফলতা আনতে পেরেছে বলে বোঝা যায় না
সমাজের দিকে তাকিয়ে।
যাহোক, সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধান রাতারাতি হবে না,
হবার প্রশ্নই উঠে না। গোটা ব্যাপারটা শত শত বছর
ধরে গড়ে উঠেছে। মুসলিম সমাজে নারীর
সবকিছু নিয়ে কথা বলেছে বাইরের মানুষরাই বেশি।
সেকথা একটু আগেই বলেছি। নিঃসন্দেহে
ভুক্তভোগী মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে
নারীদেরকে শিক্ষিত হবার জন্য চেষ্টা করা উচিৎ
ছিলো। বিষয়টা কঠিন, বিষয়টা আসলেই কঠিন। কিন্তু
এটাই পথ। এর তুলনাটা অনেকটা এমন যে, একটা বিশাল
অট্টালিকা হবার জন্য হয়ত কোন জায়গা বিরান পড়ে
ছিলো। কারো অনেক প্রয়োজন ছিলো একটা
বাড়ি, কিন্তু তার সেখানে থাকা হলো না। তিনি যদি
এটাকে গড়ে না তোলেন সময় নিয়ে (যে
সময়ে তিনি সেখানে আরাম করে থাকতে
পারতেন) তাহলে পরের প্রজন্মও আর সেখানে
থাকতে পারবে না। তারা আরো বড় সমস্যায় পড়বে।
আমার কাছে বেশ কিছু বিষয়কে সমস্যার মনে
হয়েছে। সেগুলোর কারণগুলোও ভিন্ন, সমাধানও
অনেক আলোচনাসাপেক্ষ। তার মাঝে কিছু সমস্যা
হলো --
প্রথমত, সমাজে এখনো অনেক মেয়েই
মনে করে বিয়ের পরে তো অশান্তি আর
কষ্টে সব ভরপুর, এখন যদি একটু মজা করে না
নিই তাহলে আর লাইফে কখনো আনন্দ হবে
না। তাই তারা বেশ ছেলেবন্ধুর দলেও যায়,
এলোমেলো অজস্র কাজ করে যা হয়ত মজার
নামে। কখনই সেগুলো ভবিষ্যত জীবনে শান্তি
আনে না, কেননা এইসব করতে গিয়ে অজস্র
জটিলতায় একটা মেয়ের জীবন আটকে যায়।
অনেক ঘটনা হয়, রটনা হয় -- এগুলো থেকে
কেউ বের হতে পারে না। এর পেছনে পুরুষের
ভূমিকা আছে। বড় ভূমিকা। তা হলো, পুরুষদের মাঝে
নারীর প্রতি সম্মানের বিশাল অভাব। এটা মূলত
পারিবারিক ক্ষেত্রেই শুরু হয়, সামাজিকীকরণের
সময়ে তা প্রলম্বিত হয়।
বেশিরভাগ ছেলে সারাজীবন বড় হয় নারীকে
কেবল ভোগ করার, আনন্দ করার উপযোগী অংশ
হিসেবে। ফ্রেন্ড সার্কেলে কমবেশি সবাই
নারীর শরীর নিয়ে আলাপ করে, আলাপ করে
সৌন্দর্য নিয়ে, "মাল" টাইপের শব্দ দিয়ে সম্বোধন
করে অবলীলায়। এমনটাই কালচার ম্যাক্সিমাম
ফ্রেন্ড সার্কেলের। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায়
নারীর পোশাক স্বল্প করে করে প্রতিটি
বিলবোর্ডে আর কমার্শিয়ালে তাকে পণ্যে
রূপান্তরিত করা হয়েছে। অথচ নারীরা মা, নারীরা
বোন, নারীরা স্ত্রীর মতন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
সম্পর্ক ও দায়িত্ব পালন করছেন -- তার স্বীকৃতি ও
প্রচারণা ও সচেতনতা খুব কমই প্রজন্মের পুরুষ তথা
নারীদেরও উপলব্ধিতে পড়ে। নব্য প্রজন্মের
নারীরাও অপর নারীদের গালাগালি করে অশ্রাব্য
ভাষায় -- নষ্ট সংস্কৃতির পুরুষদের সমান স্মার্ট হবার
দাসত্ব মনোভাব তাদের টেনে কোথায় নিয়ে
গেছে। সেই ভোগবাদী সমাজে ছেলেরা
নারীর যে সম্মান, মানসিক প্রয়োজন,
অধিকারগুলো প্রতি খেয়াল রাখা যে একটা বিষয় সে
বিষয়ে তার তেমন জানাই হয় না, ভেবেও
দেখেনা। এই শিক্ষার অভাবের পেছনে যেমন
তার বাবা নামের পুরুষটি কাজ করেনি, মা নামের
নারীটিরও ভূমিকা থাকে না।
এক বা একাধিক প্রজন্মে কিছু নারীকে এগিয়ে
আসতেই হবে যারা বর্তমানের সাফারিং তথা
যন্ত্রণাগুলোকে সহ্য করবেন এবং শিক্ষা দিয়ে,
প্রচুর পরিমাণে কাজ করে আরো নতুন অনেক
খোঁটা-বাঁকা কথা ও যন্ত্রণা সহ্য করে হলেও
সমাজে নারীর প্রতি মানসিকতার উন্নয়নে কাজ
করবেন। এখানে মুখে কথার চাইতে কাজের
প্রয়োজনীয়তা অত্যাধিক।
দ্বিতীয়ত, আমার কাছে মনে হয়েছে, একটা
সমাজে নীতিহীনতা, কদর্যতা আর অন্যায় ও
অশ্লীলতার যতই প্রসার হবে -- মূলত নারীর
যন্ত্রণা ও অত্যাচার ক্রমাগত বাড়বে। নিঃসন্দেহে
সমাজের সবাইই একটি খারাপ পরিস্থিতির ভুক্তভোগী
হবে। কিন্তু সেটা পুরুষের তুলনায় নারীর জন্য
সীমাহীন যন্ত্রণাদায়ক ও খারাপ হয়। অন্তত সেটা
মাতৃত্বসুলভ অনুভূতি আর মনের কারণেই হোক বা
শারীরিক ও মানসিক কোমলতার কারণেই হোক।
কল্যাণ যারা বুঝেন, সেসব চিন্তাবিদগণ নারীদের
প্রচন্ড অনুপ্রেরণা দেন এগিয়ে আসার জন্য।
সন্তান হয়েছে, শারীরিকভাবে হয়ত কিছুটা দুর্বল ও
পারিবারিক জটিলতাও তৈরি হয়েছে -- কিন্তু পড়াশোনায়
এগিয়ে আসা উচিৎ। মুসলিম নারীরা স্বেচ্ছাচারী
হতে পারে না। স্বেচ্ছাচারিতা মুসলিমের কোন
চরিত্র নয়। কিন্তু জটিলতা নিরসনে নারীদেরই কথা
বলতে হবে এবং তাদের এই সমাজের অংশ হতে
হবে। এই সমাজের মুসলিম মানসিকতাকে তাদের
বুঝতে হবে।
তৃতীয়ত, জোর করে মেয়েদের বিয়ে
দেয়াটা কখনই ইসলামিক নয়। এই বিষয়টা বাংলাদেশের
সমাজে মাত্রাতিরিক্ত রকমের প্রসার পেয়েছে।
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করা মেয়ে, ডাক্তার
ইঞ্জিনিয়ার মেয়েরাও মা-বাবার জোরাজুরিতে বিয়ে
করতে বাধ্য হয় এমন কাউকে যাদের প্রতি তার
বিশ্বাস ও সম্মান তৈরি হয়নি, মুগ্ধতাও না। একটা যথেষ্ট
বড় হয়ে যাওয়া (বা কম বয়স হলে তো কথাই নেই)
মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেয়ার এই
কালচারের কারণে সেই মেয়েটির অনাগত
জীবনকে নিঃসন্দেহে ভোগান্তির জীবন
হিসেবে শুরু করে দেয়া হয়।
চতুর্থত, নারীর গায়ে হাত তোলার একটি সংস্কৃতি
অজস্র মুসলিম পরিবারেও বিদ্যমান (ধর্মীয়
আদর্শবিহীন পরিবারে তো আছেই) এবং এটা
অস্বীকার করার উপায় নেই। এই বিষয় অস্বীকার
করে অনেকে ধামাচাপা দিতে চান বা বিভিন্ন দলীল
এনে এটাকে নির্লজ্জভাবে চালিয়ে দিতে চান।
অথচ সচরাচর পরিবারগুলোতে অবলীলায়
মেয়েদের গায়ে হাত তোলা হয়, বাপের বাড়িতে
পাঠিয়ে দেয়ার ভয় দেখানো হয়। একটি সংসার কখনই
একটি পুরুষের একার নয়, আল্লাহর কাছে প্রতিটা
মানুষের অবস্থান একসমান। সে এই কাজটি করার
অধিকার রাখে না, সেটা না বুঝতে চাওয়ার জন্য
আল্লাহভীতিহীন অহংসম্পন্ন মুসলিম হতে হয়
কেবল।
পঞ্চমত, এখনো বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে
উত্তরাধিকার ও সম্পত্তি ভাগাভাগিতে আল্লাহভীতির
চিহ্নও নাই। সরকার আধা-আধা টাইপের অ-ইসলামিক
নীতি চাপিয়ে কেবল ইসলামকেই অবজ্ঞা
করেছে যা মূলত প্রকৃত পরিস্থিতিকে ঘোলাটে
করেছে। পরিবারে ভাইয়েরা যখন বোনকে
অবজ্ঞা ও অবহেলা করে সম্পদের বন্টন
থেকে বঞ্চিত করে -- সেখানে আইনের
ঝামেলা করে সম্পর্কটাকে থানা-পুলিশ-সালিশে সমাধান
হয় না। এখানে অনেক বেশি দরকার ছিল ইমাম-মুফতি
এবং মুসলিম মনের মাঝে পরিবর্তন।
সমস্যাগুলো দেখে একটা বিষয় আমার মাঝে
বারবার মনে হয়েছে। এখানে মুসলিম মনের
পরিবর্তনই আবশ্যক। নারীরা ভুক্তভোগী মন
আর কষ্ট নিয়ে বসে থাকলে কখনই সমাধান
আসবে না -- বরং নিজেদেরকে এগিয়ে
আসতে হবে ইসলামের শিক্ষায়। নারীবাদিতার
তীর্যক পুরুষবিদ্বেষ মানসিকতা থেকে নয় বরং
ইসলামের আদল তথা ন্যায় বিচার, ইহসান, সৎব্যবহার,
সঠিক অধিকারকে নিশ্চিত করার মানসিকতা থেকেই
এইসব ইসলামিক বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে
নারীদেরকে।
ভুগতে ভুগতে মা-খালা, নানী-দাদীরা চোখের পানি
ফেলেই জীবন পেরিয়ে গেছেন। এমনও নয়
যে তাদের সঙ্গী পুরুষেরাও অনেক সুখে
থেকেছেন। হয়ত বিভিন্ন মারপ্যাঁচে পড়ে কষ্ট
এবং যন্ত্রণা নারীদেরকেই আষ্টেপৃষ্ঠে
বেঁধেছে। এখন যারা যে বয়সেই আছেন,
এগিয়ে আসা উচিৎ জ্ঞানার্জনে। শিক্ষার্জনের বয়স
নেই। অনেক মহিলা দেখেছি যারা ৩০/৩৫ বছরে
সন্তান কোলে নিয়ে পড়েছেন। এমন ঘটনা
আশেপাশেই আছে। তবে, পরিবর্তনে এগিয়ে না
আসলে কিছু বদলাবে না। আল্লাহর পৃথিবীতে,
আল্লাহর সৃষ্টি মানুষদের মাঝে আদল, ইহসান প্রতিষ্ঠা
করতে নারীর ভূমিকা যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,
তেমনি পুরুষেরও। নইলে, কিয়ামাতের দিন জবাবদিহিতা
যে পুরুষ বা নারী কারো জন্যই সহজ হবে না ,
সেই বিষয়ে হলফ করে বলে দেয়া যায়।
লিখেছেন - সাফওয়ান
Comments
Post a Comment