প্রেম ১
প্রেম ১

আমার এক ক্যানাডিয়ান সহকর্মী আলাপ করছিল, ওর
বাবামার যখন বিয়ে হয় তখন ওর মায়ের বয়স আঠারো
আর বাবার বয়স বিশ। বিয়ের তিনমাসের মাথায় ওর
বড়বোনের জন্ম। বোঝাই যায় বিয়েটা ছিল
সামাজিকতা রক্ষার তাগিদে, সুখের টানে নয়। বিয়ের
পর ওর বাবা সংসারের দায়িত্বের চাপে পড়াশোনা
চালিয়ে যেতে ব্যার্থ হয়, ওর মা পড়াশোনা করে
উকিল হন। এক পর্যায়ে এই শিক্ষিতা, স্মার্ট এবং মোটা
টাকা উপার্জনকারী মহিলার এই অশিক্ষিত এবং স্বল্প
উপার্জনকারী স্বামীকে নিজের সাথে বড়
বেমানান মনে হতে থাকে। বিয়ের একুশ বছর পর
স্ত্রী এক পুরুষকে এবং স্বামী আরেক মহিলাকে
নিয়ে আলাদা হয়ে যান। আমার সহকর্মী মেয়েটির
বয়স তখন সতেরো। সতেরো বছর বয়সে সে
অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। এ’সময় থেকে সে
অসহায়ত্ব এবং একাকীত্ব থেকে মুক্তি পেতে
এক বয়ফ্রেন্ড থেকে আরেক বয়ফ্রেন্ডের
আশ্রয় নিতে থাকে। তবে গত বারো বছর যাবত
সে একজনের সাথে বসবাস করছে। আমার চাইনিজ
বান্ধবী জেইন বলল, ‘তুমি তাকে বিয়ে করলেই
পারো’। সে বলে, ‘পাগল! আমার মায়ের ডিভোর্স
হয়ে যাবার পর আমি কিছুদিন জীবিকা নির্বাহের জন্য
একটি পারিবারিক আইন অফিসে কাজ করেছি।
সেখানে আমার বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে এমন সব
ভীতিকর অভিজ্ঞতা হয়েছে যে আমি তখনই
সিদ্ধান্ত নেই আমি কোনদিন বিয়ে করবনা’। ওর
বড়বোনের বিয়ে হোল মাত্র ক’দিন আগে।
বিবাহভীতি কাটিয়ে উঠতে উঠতে তাঁর বেয়াল্লিশ
বছর বয়স হয়ে যায়। এখন তিনি বিবাহিত হলেও
সন্তানধারনে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। আমার
সহকর্মীরও সন্তান নেয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
এমন উপাখ্যান এখানকার ঘরে ঘরে। সচেতন
বাবামায়েরা সন্তানদের চার্চে নিয়ে গিয়ে প্রতিজ্ঞা
করান তারা বিয়ের আগে পর্যন্ত কুমারী থাকবে
যেন বুঝেশুনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার অবকাশ
থাকে এবং এমন দুঃখজনক পরিণতি এড়ানো যায়। কিন্তু
প্রচলিত সমাজব্যাবস্থা এবং দৃঢ় নৈতিক বন্ধনের
অভাবের কারণে অনেকেই এই প্রতিজ্ঞা শেষ
পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনা। ফলে ভুগতে হয়
সারাজীবন।
প্রেম একটি অসাধারন এবং মোহময় অনুভূতি। সেদিন
দেখলাম এক বুড়ো দাদা যিনি নিজেই সোজা হয়ে
দাঁড়াতে পারেন না, ওষুধের দোকান থেকে
বেরিয়ে একহাতে তাঁর বৃদ্ধা স্ত্রীকে শক্ত
করে ধরে আরেক হাত মাথার ওপর দিয়ে অতি
সাবধানে গাড়ীতে বসিয়ে দিচ্ছেন যেন তিনি
পিঠে ব্যাথা না পান, আবার পিঠ সোজা রাখতে গিয়ে
মাথায় বাড়ি না খান। একইভাবে আমরা যখন গর্ভবতী
স্ত্রীর পাশে চিন্তাক্লিষ্ট স্বামীটিকে
অস্থিরভাবে পায়চারী করতে দেখি কিংবা সুন্দরী
হবু স্ত্রীর দিকে তাকাতে গিয়েও যুবকটিকে
চোখে নামিয়ে নিতে দেখি তাতে যে ভালোবাসা
প্রকাশ পায় তা যেকোন হৃদয়কেই আপ্লুত করে।
কিন্তু প্রেমের সবটুকুই দৃষ্টিনন্দন নয়। এর একটি
পাশবিক দিকও আছে যেটি বন্ধ দরজার আড়ালেই
পরিতৃপ্ত করা শ্রেয়। যেমন ক’দিন আগে কাজে
যাবার পথে দেখি এক ট্রেন মানুষের সামনে,
যেখানে কয়েকমাসের শিশু থেকে কয়েক
দশকের বৃদ্ধরাও আছেন, দু’জন যুবক যুবতী
নিজেদের একটিমাত্র জ্যাকেট দিয়ে ঢেকে
শারীরিক প্রয়োজন পূরণ করছে! ঘটনাটি এতটাই
পশুপ্রবৃত্তি প্রকাশক ছিল যে দৃশ্যটি এমনকি কোন
নিম্নতর রুচির মানুষের কাছেও উপভোগ্য ছিলোনা
বরং সবাই হতভম্ব এবং বিরক্ত হলেও এই ব্যাপারে
আইনত কারো কিছু করার নেই বলেই কেউ বাঁধা
দিতে পারছিলোনা। ভাবছিলাম, এরা কি করে পারে
দাদাদাদীর বয়সী লোকজনের সামনে এত
নির্লজ্জ হতে? কিন্তু ব্যাপারটা আসলে
সহজবোধ্য।
মানুষের বংশরক্ষার তাগিদেই সৃষ্টিকর্তা এই জৈবিক তাড়না
মানুষের মাঝে দিয়ে দিয়েছেন। নইলে কে
সেধে স্ত্রীপুত্রকন্যার দায়িত্ব মাথায় নিত? কেইবা
বুঝেশুনে সারাজীবন ধরে এতগুলো মানুষের
জন্য প্রতিবেলা রান্না করা, কাপড় ধোয়া, ঘর পরিস্কার
করার কাজ করত? এটি ক্ষুধা কিংবা তৃষ্ণার চেয়ে অধিক
বা অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয়। তবে তিনি মানুষকে
সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে,
সমস্ত সৃষ্টিকুল হতে স্বতন্ত্র এবং বিশেষায়িত
করে। প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারে আমরা এই
পার্থক্য দেখতে পাই। যেমন পশুদের মাঝে পুরুষ
প্রানী অধিকতর সুন্দর, মানুষের মাঝে নারী;
বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেছেন পশুরা বাঁহাতি
কিন্তু মানুষকে তাদের প্রভু বলে দিয়েছেন
ডানহাতে অধিকাংশ কাজ করতে; পশুরা কাঁচা খাবার খায়
আর মানুষ খায় সেদ্ধ করে। একইভাবে পশুরা
বাড়ীঘর না থাকায় সর্বসমক্ষে কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ
করতে বাধ্য হলেও মানুষকে বলা হয়েছে এর
জন্য বিশেষ পন্থা এবং পদ্ধতি অবলম্বন করতে
যেন এর মাধ্যমে যে জীবন পৃথিবীতে আগমন
করবে তা বেড়ে ওঠার একটি সুস্থ এবং সুষ্ঠু
পরিবেশ পায়।
এই প্রক্রিয়াকে সহজ এবং স্বাভাবিক করার জন্যই
সৃষ্টিকর্তা নির্দেশ দিয়েছেন নিজেকে
সর্বসমক্ষে কামনার বস্তুরূপে উপস্থাপন না করে
নিজের আকর্ষনী শক্তিকে আড়াল করে রাখতে।
চাহিদার সৃষ্টি দৃষ্টি থেকে। আমরা যদি না জানি বাসায় মিষ্টি
আছে, আমাদের মিষ্টি না খেলেও দিব্যি দিন
কেটে যায়। কিন্তু টেবিলের ওপর মিষ্টি আছে
অথচ আমি খাবনা তা কি হয়? যদি বলেন, ‘তোমার
ডায়াবেটিস, খেলে ক্ষতি হবে’, উত্তর আসবে,
‘আরে ডাক্তার কি জানে? আগে তো খেয়ে
নেই, তারপর দেখা যাবে যা হবার হবে!’ একটি
মেয়ের সৌন্দর্য যদি কেউ না দেখে তাহলে
কেউ জানবেনা মেয়েটি কতটা আকর্ষনীয় এবং
তার সবটুকু আবেদন সংরক্ষিত হবে তার জীবনের
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিটির জন্য। আবার যে
মেয়েটির পুরুষদের সাথে মেলামেশা স্বল্প
পরিসরে সে স্বামীর প্রতিটি সদ্গুনকেই
অ্যাপ্রিশিয়েট করতে পারবে। কিন্তু যে মেয়েটি
বহু পুরুষের সাথে মিশে অভ্যস্ত সে বিয়ের পর
প্রতিটি মূহূর্ত মনে মনে তুলনা করবে আমার স্বামী
দেখতে অমুকের মত সুন্দর না, তমুকের মত
সুন্দর করে কথাবার্তা বলতে
জানেনা, অমুকের মত
গাইতে জানেনা, তমুকের মত স্মার্ট নয়, অমুকের
মত বিত্তশালী নয় কিংবা তমুকের মত শক্তিশালী নয় -
তখন মনের আক্ষেপ দূর করে সেই লোককে
নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা কঠিন ব্যাপার বৈকি!
যার আকর্ষনী শক্তি সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত
সে নিজেও ভুলের জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।
একটি প্রজাপতি উড়ে এলে তার সৌন্দর্য যাচাই বাছাই
কিংবা পরখ করে নেয়া যায়, কিন্তু ঝাঁকে ঝাঁকে
পঙ্গপাল উড়ে এলে আর বাছাই করার সুযোগ
থাকেনা। প্রজাপতিকে মানুষ যত্ন করে ঘরের
দেয়ালে বসতে দেয় কিন্তু কারো ঘরে
পঙ্গপাল প্রবেশ করবে তা মানুষ দুঃস্বপ্নেও
ভাবতে পারেনা। নিজেকে প্রদর্শনীতে দিয়ে
সাড়া পেলে প্রথম প্রথম সবারই ভাল লাগে। কিন্তু
তারপর যখন ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল এসে চারিদিকে
ঘিরে ফেলে তখন আর সামাল দিয়ে ওঠা যায়না। তাই
এদের জৈবিক তাড়না চরিতার্থ করার কোন নির্দিষ্ট
স্থান থাকেনা, কোন বৈধ পন্থাও থাকেনা যেহেতু
এরা কেবল ভোগ করতে চায় কিন্তু দায়িত্ব নিতে
চায়না। এই চাহিদাপূরনের ফলাফল হিসেবে যে
সন্তানের জন্ম হয় তারও কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা গড়ে
ওঠেনা কারণ সে কেবল একটি জৈবিক প্রক্রিয়ায়
ফলাফল, কাঙ্খিত নয় মোটেই। অথচ এই
পৃথিবীতে আসার পেছনে বেচারার না হাত ছিল, না
ছিল ইচ্ছা। শুরু হয় আরেকটি কষ্টের উপাখ্যান।
খুব কম মানুষের বোধের আয়নায় এই সত্য
প্রতিফলিত হয় যে প্রেম কেবল জৈবিক তাড়নার
বহিঃপ্রকাশ নয় বরং একটি পবিত্র মানসিক বন্ধন। এই
বন্ধনকে মজবুত করার জন্য একে একটি সামাজিক রূপ
দেয়া জরুরী যাতে উভয়পক্ষের সামাজিক নিরাপত্তা
এবং অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান হয়। তাই প্রেমের
সৃষ্টিকর্তা প্রনীত এবং সবচেয়ে শ্বাশ্বত রূপ
বিয়ে। এর অর্থ এই নয় যে বিয়ে করলে কোন
সমস্যাই হবেনা। দু’জন মানবমানবী যারা দু’টি ভিন্ন ভিন্ন
অঙ্গনে পৃথক পৃথক পরিবেশে বেড়ে উঠেছে
তারা মিলিত হলেও দু’টি নদীর মতই সমান্তরালে বহমান
থাকবে, একীভূত হবেনা। কিন্তু একটি বিবাহিত
দম্পতিকে তাদের পরিবার পরিজন বন্ধু বান্ধব
থেকে সম্পূর্ন অপরিচিত লোকজন পর্যন্ত
একত্রে বসবাস করতে, নিজেদের সমস্যার সমাধান
করতে সহযোগিতা করে। অপরদিকে একটি অনৈতিক
বন্ধনে জড়িত দুই ব্যাক্তি - যাদের সম্পর্কের
কোন গন্তব্য নেই, কোন উদ্দেশ্য নেই শুধু
নিজেদের চাহিদা পূরণ করা ব্যাতীত - হাতেগোনা
কিছু লোকজন ছাড়া কেউ সাহায্য করেনা। ফলে
ঠুনকো সম্পর্কটি জোরদার হবার কোন ভিত্তি
খুঁজে পায়না। নাটকে সিনেমায় এমন সম্পর্কগুলোর
ট্রাজেডি, কমপ্লিকেশন কিংবা হঠাৎ করে সব মেঘ
কেটে গিয়ে সূর্য হেসে ওঠা দেখতে যতই ভাল
লাগুক না কেন বাস্তবে কেউ এমন ঘটনার
সম্মুখীন হতে চায়না, বাস্তবে এমন আলৌকিকভাবে
সমস্যার সমাধান কমই ঘটে।
সুতরাং, আমরা সাবধান হই। একটিমাত্র জীবন আমাদের।
ক্ষণিকের আনন্দের জন্য আমরা যেন
আত্মনিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে পাহাড়ের ওপর
থেকে গিরিখাদে ধারালো পাথরের ওপর আছড়ে
পড়ে জীবনাবসানকে বেছে না নেই। বরং
আমাদের পছন্দগুলোর ভিত্তি হোক মানবিক গুনের
সমাহার, বিশ্বাসের একাত্মতা, পারস্পরিক সম্মানবোধ
এবং প্রতিকুলতায় বন্ধুত্বের ছায়া যেন বার্ধক্যের
দিনগুলোতে আমরা পরস্পরের হাত ধরে অস্তমিত
সূর্যের দিকে হেঁটে যেতে পারি এই প্রগাঢ়
বিশ্বাসে যে ওপাড়েও সে আমার হাত ছেড়ে
দেবেনা।
লিখেছেন - রেহনুমা বিনত আনিস

আমার এক ক্যানাডিয়ান সহকর্মী আলাপ করছিল, ওর
বাবামার যখন বিয়ে হয় তখন ওর মায়ের বয়স আঠারো
আর বাবার বয়স বিশ। বিয়ের তিনমাসের মাথায় ওর
বড়বোনের জন্ম। বোঝাই যায় বিয়েটা ছিল
সামাজিকতা রক্ষার তাগিদে, সুখের টানে নয়। বিয়ের
পর ওর বাবা সংসারের দায়িত্বের চাপে পড়াশোনা
চালিয়ে যেতে ব্যার্থ হয়, ওর মা পড়াশোনা করে
উকিল হন। এক পর্যায়ে এই শিক্ষিতা, স্মার্ট এবং মোটা
টাকা উপার্জনকারী মহিলার এই অশিক্ষিত এবং স্বল্প
উপার্জনকারী স্বামীকে নিজের সাথে বড়
বেমানান মনে হতে থাকে। বিয়ের একুশ বছর পর
স্ত্রী এক পুরুষকে এবং স্বামী আরেক মহিলাকে
নিয়ে আলাদা হয়ে যান। আমার সহকর্মী মেয়েটির
বয়স তখন সতেরো। সতেরো বছর বয়সে সে
অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। এ’সময় থেকে সে
অসহায়ত্ব এবং একাকীত্ব থেকে মুক্তি পেতে
এক বয়ফ্রেন্ড থেকে আরেক বয়ফ্রেন্ডের
আশ্রয় নিতে থাকে। তবে গত বারো বছর যাবত
সে একজনের সাথে বসবাস করছে। আমার চাইনিজ
বান্ধবী জেইন বলল, ‘তুমি তাকে বিয়ে করলেই
পারো’। সে বলে, ‘পাগল! আমার মায়ের ডিভোর্স
হয়ে যাবার পর আমি কিছুদিন জীবিকা নির্বাহের জন্য
একটি পারিবারিক আইন অফিসে কাজ করেছি।
সেখানে আমার বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে এমন সব
ভীতিকর অভিজ্ঞতা হয়েছে যে আমি তখনই
সিদ্ধান্ত নেই আমি কোনদিন বিয়ে করবনা’। ওর
বড়বোনের বিয়ে হোল মাত্র ক’দিন আগে।
বিবাহভীতি কাটিয়ে উঠতে উঠতে তাঁর বেয়াল্লিশ
বছর বয়স হয়ে যায়। এখন তিনি বিবাহিত হলেও
সন্তানধারনে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। আমার
সহকর্মীরও সন্তান নেয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
এমন উপাখ্যান এখানকার ঘরে ঘরে। সচেতন
বাবামায়েরা সন্তানদের চার্চে নিয়ে গিয়ে প্রতিজ্ঞা
করান তারা বিয়ের আগে পর্যন্ত কুমারী থাকবে
যেন বুঝেশুনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার অবকাশ
থাকে এবং এমন দুঃখজনক পরিণতি এড়ানো যায়। কিন্তু
প্রচলিত সমাজব্যাবস্থা এবং দৃঢ় নৈতিক বন্ধনের
অভাবের কারণে অনেকেই এই প্রতিজ্ঞা শেষ
পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনা। ফলে ভুগতে হয়
সারাজীবন।
প্রেম একটি অসাধারন এবং মোহময় অনুভূতি। সেদিন
দেখলাম এক বুড়ো দাদা যিনি নিজেই সোজা হয়ে
দাঁড়াতে পারেন না, ওষুধের দোকান থেকে
বেরিয়ে একহাতে তাঁর বৃদ্ধা স্ত্রীকে শক্ত
করে ধরে আরেক হাত মাথার ওপর দিয়ে অতি
সাবধানে গাড়ীতে বসিয়ে দিচ্ছেন যেন তিনি
পিঠে ব্যাথা না পান, আবার পিঠ সোজা রাখতে গিয়ে
মাথায় বাড়ি না খান। একইভাবে আমরা যখন গর্ভবতী
স্ত্রীর পাশে চিন্তাক্লিষ্ট স্বামীটিকে
অস্থিরভাবে পায়চারী করতে দেখি কিংবা সুন্দরী
হবু স্ত্রীর দিকে তাকাতে গিয়েও যুবকটিকে
চোখে নামিয়ে নিতে দেখি তাতে যে ভালোবাসা
প্রকাশ পায় তা যেকোন হৃদয়কেই আপ্লুত করে।
কিন্তু প্রেমের সবটুকুই দৃষ্টিনন্দন নয়। এর একটি
পাশবিক দিকও আছে যেটি বন্ধ দরজার আড়ালেই
পরিতৃপ্ত করা শ্রেয়। যেমন ক’দিন আগে কাজে
যাবার পথে দেখি এক ট্রেন মানুষের সামনে,
যেখানে কয়েকমাসের শিশু থেকে কয়েক
দশকের বৃদ্ধরাও আছেন, দু’জন যুবক যুবতী
নিজেদের একটিমাত্র জ্যাকেট দিয়ে ঢেকে
শারীরিক প্রয়োজন পূরণ করছে! ঘটনাটি এতটাই
পশুপ্রবৃত্তি প্রকাশক ছিল যে দৃশ্যটি এমনকি কোন
নিম্নতর রুচির মানুষের কাছেও উপভোগ্য ছিলোনা
বরং সবাই হতভম্ব এবং বিরক্ত হলেও এই ব্যাপারে
আইনত কারো কিছু করার নেই বলেই কেউ বাঁধা
দিতে পারছিলোনা। ভাবছিলাম, এরা কি করে পারে
দাদাদাদীর বয়সী লোকজনের সামনে এত
নির্লজ্জ হতে? কিন্তু ব্যাপারটা আসলে
সহজবোধ্য।
মানুষের বংশরক্ষার তাগিদেই সৃষ্টিকর্তা এই জৈবিক তাড়না
মানুষের মাঝে দিয়ে দিয়েছেন। নইলে কে
সেধে স্ত্রীপুত্রকন্যার দায়িত্ব মাথায় নিত? কেইবা
বুঝেশুনে সারাজীবন ধরে এতগুলো মানুষের
জন্য প্রতিবেলা রান্না করা, কাপড় ধোয়া, ঘর পরিস্কার
করার কাজ করত? এটি ক্ষুধা কিংবা তৃষ্ণার চেয়ে অধিক
বা অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয়। তবে তিনি মানুষকে
সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে,
সমস্ত সৃষ্টিকুল হতে স্বতন্ত্র এবং বিশেষায়িত
করে। প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারে আমরা এই
পার্থক্য দেখতে পাই। যেমন পশুদের মাঝে পুরুষ
প্রানী অধিকতর সুন্দর, মানুষের মাঝে নারী;
বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেছেন পশুরা বাঁহাতি
কিন্তু মানুষকে তাদের প্রভু বলে দিয়েছেন
ডানহাতে অধিকাংশ কাজ করতে; পশুরা কাঁচা খাবার খায়
আর মানুষ খায় সেদ্ধ করে। একইভাবে পশুরা
বাড়ীঘর না থাকায় সর্বসমক্ষে কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ
করতে বাধ্য হলেও মানুষকে বলা হয়েছে এর
জন্য বিশেষ পন্থা এবং পদ্ধতি অবলম্বন করতে
যেন এর মাধ্যমে যে জীবন পৃথিবীতে আগমন
করবে তা বেড়ে ওঠার একটি সুস্থ এবং সুষ্ঠু
পরিবেশ পায়।
এই প্রক্রিয়াকে সহজ এবং স্বাভাবিক করার জন্যই
সৃষ্টিকর্তা নির্দেশ দিয়েছেন নিজেকে
সর্বসমক্ষে কামনার বস্তুরূপে উপস্থাপন না করে
নিজের আকর্ষনী শক্তিকে আড়াল করে রাখতে।
চাহিদার সৃষ্টি দৃষ্টি থেকে। আমরা যদি না জানি বাসায় মিষ্টি
আছে, আমাদের মিষ্টি না খেলেও দিব্যি দিন
কেটে যায়। কিন্তু টেবিলের ওপর মিষ্টি আছে
অথচ আমি খাবনা তা কি হয়? যদি বলেন, ‘তোমার
ডায়াবেটিস, খেলে ক্ষতি হবে’, উত্তর আসবে,
‘আরে ডাক্তার কি জানে? আগে তো খেয়ে
নেই, তারপর দেখা যাবে যা হবার হবে!’ একটি
মেয়ের সৌন্দর্য যদি কেউ না দেখে তাহলে
কেউ জানবেনা মেয়েটি কতটা আকর্ষনীয় এবং
তার সবটুকু আবেদন সংরক্ষিত হবে তার জীবনের
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিটির জন্য। আবার যে
মেয়েটির পুরুষদের সাথে মেলামেশা স্বল্প
পরিসরে সে স্বামীর প্রতিটি সদ্গুনকেই
অ্যাপ্রিশিয়েট করতে পারবে। কিন্তু যে মেয়েটি
বহু পুরুষের সাথে মিশে অভ্যস্ত সে বিয়ের পর
প্রতিটি মূহূর্ত মনে মনে তুলনা করবে আমার স্বামী
দেখতে অমুকের মত সুন্দর না, তমুকের মত
সুন্দর করে কথাবার্তা বলতে
জানেনা, অমুকের মত
গাইতে জানেনা, তমুকের মত স্মার্ট নয়, অমুকের
মত বিত্তশালী নয় কিংবা তমুকের মত শক্তিশালী নয় -
তখন মনের আক্ষেপ দূর করে সেই লোককে
নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা কঠিন ব্যাপার বৈকি!
যার আকর্ষনী শক্তি সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত
সে নিজেও ভুলের জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।
একটি প্রজাপতি উড়ে এলে তার সৌন্দর্য যাচাই বাছাই
কিংবা পরখ করে নেয়া যায়, কিন্তু ঝাঁকে ঝাঁকে
পঙ্গপাল উড়ে এলে আর বাছাই করার সুযোগ
থাকেনা। প্রজাপতিকে মানুষ যত্ন করে ঘরের
দেয়ালে বসতে দেয় কিন্তু কারো ঘরে
পঙ্গপাল প্রবেশ করবে তা মানুষ দুঃস্বপ্নেও
ভাবতে পারেনা। নিজেকে প্রদর্শনীতে দিয়ে
সাড়া পেলে প্রথম প্রথম সবারই ভাল লাগে। কিন্তু
তারপর যখন ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল এসে চারিদিকে
ঘিরে ফেলে তখন আর সামাল দিয়ে ওঠা যায়না। তাই
এদের জৈবিক তাড়না চরিতার্থ করার কোন নির্দিষ্ট
স্থান থাকেনা, কোন বৈধ পন্থাও থাকেনা যেহেতু
এরা কেবল ভোগ করতে চায় কিন্তু দায়িত্ব নিতে
চায়না। এই চাহিদাপূরনের ফলাফল হিসেবে যে
সন্তানের জন্ম হয় তারও কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা গড়ে
ওঠেনা কারণ সে কেবল একটি জৈবিক প্রক্রিয়ায়
ফলাফল, কাঙ্খিত নয় মোটেই। অথচ এই
পৃথিবীতে আসার পেছনে বেচারার না হাত ছিল, না
ছিল ইচ্ছা। শুরু হয় আরেকটি কষ্টের উপাখ্যান।
খুব কম মানুষের বোধের আয়নায় এই সত্য
প্রতিফলিত হয় যে প্রেম কেবল জৈবিক তাড়নার
বহিঃপ্রকাশ নয় বরং একটি পবিত্র মানসিক বন্ধন। এই
বন্ধনকে মজবুত করার জন্য একে একটি সামাজিক রূপ
দেয়া জরুরী যাতে উভয়পক্ষের সামাজিক নিরাপত্তা
এবং অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান হয়। তাই প্রেমের
সৃষ্টিকর্তা প্রনীত এবং সবচেয়ে শ্বাশ্বত রূপ
বিয়ে। এর অর্থ এই নয় যে বিয়ে করলে কোন
সমস্যাই হবেনা। দু’জন মানবমানবী যারা দু’টি ভিন্ন ভিন্ন
অঙ্গনে পৃথক পৃথক পরিবেশে বেড়ে উঠেছে
তারা মিলিত হলেও দু’টি নদীর মতই সমান্তরালে বহমান
থাকবে, একীভূত হবেনা। কিন্তু একটি বিবাহিত
দম্পতিকে তাদের পরিবার পরিজন বন্ধু বান্ধব
থেকে সম্পূর্ন অপরিচিত লোকজন পর্যন্ত
একত্রে বসবাস করতে, নিজেদের সমস্যার সমাধান
করতে সহযোগিতা করে। অপরদিকে একটি অনৈতিক
বন্ধনে জড়িত দুই ব্যাক্তি - যাদের সম্পর্কের
কোন গন্তব্য নেই, কোন উদ্দেশ্য নেই শুধু
নিজেদের চাহিদা পূরণ করা ব্যাতীত - হাতেগোনা
কিছু লোকজন ছাড়া কেউ সাহায্য করেনা। ফলে
ঠুনকো সম্পর্কটি জোরদার হবার কোন ভিত্তি
খুঁজে পায়না। নাটকে সিনেমায় এমন সম্পর্কগুলোর
ট্রাজেডি, কমপ্লিকেশন কিংবা হঠাৎ করে সব মেঘ
কেটে গিয়ে সূর্য হেসে ওঠা দেখতে যতই ভাল
লাগুক না কেন বাস্তবে কেউ এমন ঘটনার
সম্মুখীন হতে চায়না, বাস্তবে এমন আলৌকিকভাবে
সমস্যার সমাধান কমই ঘটে।
সুতরাং, আমরা সাবধান হই। একটিমাত্র জীবন আমাদের।
ক্ষণিকের আনন্দের জন্য আমরা যেন
আত্মনিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে পাহাড়ের ওপর
থেকে গিরিখাদে ধারালো পাথরের ওপর আছড়ে
পড়ে জীবনাবসানকে বেছে না নেই। বরং
আমাদের পছন্দগুলোর ভিত্তি হোক মানবিক গুনের
সমাহার, বিশ্বাসের একাত্মতা, পারস্পরিক সম্মানবোধ
এবং প্রতিকুলতায় বন্ধুত্বের ছায়া যেন বার্ধক্যের
দিনগুলোতে আমরা পরস্পরের হাত ধরে অস্তমিত
সূর্যের দিকে হেঁটে যেতে পারি এই প্রগাঢ়
বিশ্বাসে যে ওপাড়েও সে আমার হাত ছেড়ে
দেবেনা।
লিখেছেন - রেহনুমা বিনত আনিস
Comments
Post a Comment