তালাক নিয়ে ভ্রান্ত মাসয়ালা

তালাক সম্পর্কিত কিছু ভুলত্রুটি

এ সংখ্যায় শুধু এ বিষয়ে আলোচনা করাই
মুনাসিব মনে হল। একটি কথা তো বারবার
লেখা হয়েছে, ওলামা-মাশায়েখও আলোচনা
করে থাকেন যে, অতীব প্রয়োজন (যা
শরীয়তে ওজর বলে গণ্য) ছাড়া স্বামীর জন্য
যেমন তালাক দেওয়া জায়েয নয় তেমনি
স্ত্রীর জন্যও তালাক চাওয়া দুরস্ত নয়।
তালাকের পথ খোলা রাখা হয়েছে শুধু অতীব
প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য।
বর্তমান সমাজে, বিশেষ করে আমাদের
এতদাঞ্চলে কোনো পরিবারে তালাকের
ঘটনা যে কত ফাসাদ-বিশৃঙ্খলা, জুলুম-
অত্যাচার এবং ঝগড়া-বিবাদের কারণ হয় তা
আর বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। তালাক
প্রদানের ক্ষমতাকে শরীয়তের নির্ধারিত
নীতিমালার বাইরে ব্যবহার করা
নিঃসন্দেহে আল্লাহর বিধানের সাথে
বালখিল্যতার শামিল।
এজন্য কেউ দাম্পত্য জীবনে পা রাখার
চেষ্টা করলে তার অপরিহার্য কর্তব্য হবে,
বিয়ের আগেই দাম্পত্য জীবনের নিত্য
প্রয়োজনীয় মাসআলাগুলোর সাথে
তালাকের বিধানসমূহ জেনে নেওয়া।
তালাক অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। কেউ
এই ক্ষমতার অপব্যবহার করলে কিংবা ভুল
পন্থায় তা প্রয়োগ করলে সে একদিকে যেমন
গুনাহগার হবে অন্যদিকে তালাকও কার্যকর
হয়ে যাবে। তাই প্রতিটি বিবেচক স্বামীর
দায়িত্ব হল, তালাকের শব্দ কিংবা এর
সমার্থক কোনো শব্দ মুখে উচ্চারণ করা থেকে
সতর্কতার সাথে বিরত থাকা।
অবশ্য অতীব প্রয়োজনে তালাক প্রদানে
বাধ্য হলে স্ত্রীর পবিত্র অবস্থায় শুধু এক
তালাক দিয়ে ক্ষান্ত হওয়া উচিত। এভাবে
বলবে যে, ‘তোমাকে তালাক দিলাম।’
তালাকের সাথে ‘বায়েন’ শব্দ কিংবা ৩
সংখ্যা ব্যবহার করবে না। কেউ ‘বায়েন’ শব্দ
বলে ফেললে (চাই তা এক বা দুই তালাক
হোক না কেন) নতুন করে শরীয়তসম্মত পন্থায়
বিবাহ দোহরানো ছাড়া স্ত্রীর সাথে পুনরায়
মিলনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
অনুরূপভাবে তিন তালাক দিয়ে ফেললে-একই
মজলিসে পৃথক পৃথকভাবে তিন তালাক দেওয়া
হোক কিংবা একই শব্দে তিন তালাক দেওয়া
হোক- যেমন বলল, তোমাকে তিন তালাক
দিলাম। অথবা আগে কখনো দুই তালাক
দিয়েছিল আর এখন শুধু এক তালাক দিল।
সর্বমোট তিন তালাক দেওয়া হল। যেকোনো
উপায়ে তিন তালাক দেওয়া হলে বৈবাহিক
সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যায়। এ অবস্থায়
শুধু মৌখিকভাবে স্ত্রীকে বিবাহে ফিরিয়ে
আনার যেমন কোনো সুযোগ থাকে না তেমনি
নতুন করে বিবাহ দোহরানোর মাধ্যমেও
ফিরিয়ে নেওয়ার পথ খোলা থাকে না।
একসাথে তিন তালাক দেওয়া কিংবা
বিভিন্ন সময় তালাক দিতে দিতে তিন পর্যন্ত
পৌঁছে যাওয়া একটি জঘণ্য অপরাধ ও ঘৃণিত
কাজ। আল্লাহ তাআলা এর শাস্তি হিসেবে
এই বিধান দিয়েছেন যে, তারা স্বামী-স্ত্রী
হিসেবে পুনরায় একসাথে বসবাস করতে
চাইলে স্ত্রীর ইদ্দত অতিবাহিত হওয়ার পর
অন্যত্র তার বিয়ে হওয়া এবং সে স্বামীর
সাথে তার মিলন হওয়া অপরিহার্য। এরপর
কোনো কারণে সে তালাকপ্রাপ্তা হলে
কিংবা স্বামীর মৃত্যু হলে ইদ্দত পালনের পর
এরা দুজন পরস্পর সম্মত হলে নতুন করে বিবাহ
বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।
এজন্য শরীয়ত আগেই সাবধান করে দিয়েছে
যে, প্রথমত তালাকের কথা
চিন্তাও করবে না। তবে অতীব প্রয়োজনে
কখনো তালাক প্রদানের প্রয়োজন হলে শুধু
সাদামাটা তালাক দাও, শুধু এক তালাক। যেন
উভয়ের জন্যই নতুন করে চিন্তা-ভাবনার সুযোগ
থাকে এবং পুনরায় ফিরে আসার পথ খোলা
থাকে। এরপর আবারো কোনো সমস্যা দেখা
দিলে এভাবেই শুধু এক তালাক দিবে। এখনও
ফিরে আসার পথ খোলা থাকবে।
কিন্তু এরপর যদি আবার কখনো শুধু এক
তালাকই দেওয়া হয় এবং সব মিলে তিন
তালাক হয়ে যায় এ অবস্থায় আর তাকে
ফিরিয়ে আনারও সুযোগ থাকবে না, নতুন করে
বিয়ে করার বৈধতাও বাকি থাকবে না।
আজকাল স্বামী-স্ত্রী তালাকের বিধান
জানা ও সে অনুযায়ী আমল করার পরিবর্তে
নিজেদের মনে এমনসব ভুল ও বানোয়াট
মাসআলা স্থির করে রাখে যে, আল্লাহ মাফ
করুন।
১. তিন তালাক ছাড়া কি তালাক হয় না
যেমন, কেউ মনে করে যে, শুধু এক বা দুই
তালাক দেওয়ার দ্বারা তো তালাকই হয় না।
তালাকের জন্য একসাথে তিন তালাক
দেওয়াকে তারা অপরিহার্য মনে করে।
মনে রাখবেন, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তালাক
দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি হল, শুধু এক তালাক
দেওয়া। পরবর্তীতে আবারও প্রয়োজন হলে
শুধু এক তালাকই দিবে। এরচেয়ে বেশি দিবে
না। কিন্তু তিন তালাক দিয়ে ফেললে তাদের
দাম্পত্য সম্পর্ক বহাল রাখার সকল পথ বন্ধ
হয়ে যাবে।
একই মজলিসে কিংবা একই শব্দে তিন
তালাক দেওয়া হারাম ও কবীরা গুনাহ। কিন্তু
কেউ এমনটি করলে তালাক কার্যকর হবে এবং
তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে শেষ
হয়ে যাবে।
২. তালাকের সাথে কি বায়েন শব্দ ব্যবহার
করা জরুরি
অনেকে মনে করে, শুধু তালাক বললে তালাক
হয় না; বরং তালাকের সাথে ‘বায়েন’ শব্দও
যোগ করা অত্যাবশ্যক।
এটিও ভুল ধারণা। শুধু তালাক শব্দ দ্বারাই
তালাক হয়ে যায়। এর সাথে ‘বায়েন’ শব্দ
যোগ করার কোনো প্রয়োজন নেই। উপরন্তু এ
শব্দের সংযোজন নাজায়েয। তবে কেউ যদি
এক তালাক বায়েন বা দুই তালাক বায়েন
দেয় তবে সে মৌখিকভাবে রুজু করার (পুনরায়
স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার) পথ বন্ধ করে
দিল। এখন শুধু একটি পথই খোলা আছে। আর
তা হল, নতুনভাবে শরীয়তসম্মত পন্থায় বিবাহ
দোহরানো। অথচ শুধু তালাক বললে এক
তালাক বা দুই তালাক পর্যন্ত মৌখিক রুজুর
পথ খোলা থাকে। এজন্য স্বামীর উচিত, যত
উত্তেজিতই হোক না কেন, কোনো
অবস্থাতেই যেন তিন তালাক না দেয়। এমনকি
তা কখনো মুখেও না আনে। অথচ অনেকে তো
তিন তালাক দেওয়ার পরও পৃথকভাবে ‘বায়েন’
শব্দ যোগ করেন। যেন সব কটি তালাক
দেওয়ার পরও তার মন ভরল না। না হলে তিন
তালাক দেওয়ার পর আর কী বাকি থাকে যে,
‘বায়েন’ শব্দ বলতে হবে?!
মনে রাখবেন, তিন তালাক দেওয়াই এক গুনাহ,
এরপর ‘বায়েন’ শব্দ যোগ করে সে আরো বেশি
গুনাহগার হল।
৩. একসাথে তিন তালাক দিলে কি তালাক
হয় না
অনেকে এই ভুল ধারণাও প্রচার করে
রেখেছে যে, একসাথে তিন তালাক দেওয়া
হলে তালাক হয় না কিংবা শুধু এক তালাক
হয়।
এটিও একটি মারাত্মক ভুল। একসাথে তিন
তালাক দেওয়া জায়েয না হলেও কেউ যদি
এই নাজায়েয কাজ করে তাহলে তার স্ত্রীর
উপর তিন তালাক ঠিকই পতিত হয়। এক্ষেত্রে
তার মৌখিকভাবে রুজু করার অধিকার
অবশিষ্ট থাকে না। এমনকি নতুন করে বিবাহ
দোহরিয়ে নেওয়ার দ্বারাও তারা একে
অপরের জন্য হালাল হতে পারে না। তাই সকল
স্বামীরই কর্তব্য, প্রথম থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক
থাকা। মুখ দিয়ে কখনো তিন তালাক কিংবা
তালাক, তালাক, তালাক শব্দ উচ্চারণ না
করা। আর আগেই দুই তালাক দিয়ে থাকলে
এখন আর তৃতীয় তালাকের চিন্তাও না করা।
৪. গর্ভাবস্থায় তালাক দিলে কি তালাক
পতিত হয় না
অনেকে এই মাসআলা বানিয়ে রেখেছে যে,
গর্ভাবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দেওয়া হলে
তা কার্যকর হয় না। এটিও সম্পূর্ণ অবাস্তব
কথা। গর্ভাবস্থায় হোক বা অন্য যেকোনো
অবস্থাই হোক তালাক দেওয়া হলে তা পতিত
হয়ে যায়। এজন্য সঠিক মাসআলা শেখা
সকলের দায়িত্ব। অজ্ঞতার ধোকায় থাকার
কারণে হারাম কখনো হালাল হতে পারে না।
৫. তালাক পতিত হওয়ার জন্য কি সাক্ষীর
উপস্থিতি জরুরি
অনেকের ধারণা, স্বামী তালাকের সময়
কোনো সাক্ষী না রাখলে তালাক পতিত হয়
না। আগেরটার মতো এটাও মানুষের মনগড়া
মাসআলা। কোন মূর্খ এই কথা বলেছে জানা
নেই। সাক্ষীর প্রয়োজন তো হয় বিবাহের
সময়। তালাক পতিত হওয়ার জন্য এক বা
একাধিক কোনো সাক্ষীরই প্রয়োজন নেই।
স্বামী যদি রাতের অন্ধকারে একা একা বসে
তালাক দেয় তাহলেও তালাক হয়ে যায়।
৬. রাগের অবস্থায় তালাক দিলে কি তালাক
হয় না
তালাক তো দেওয়াই হয় রাগ হয়ে। কয়জন
আছে, শান্তভাবে তালাক দেয়? আসলে তো
এমনই হওয়া উচিত ছিল যে, যদি বাস্তবসম্মত
ও অনিবার্য প্রয়োজনে বৈবাহিক সম্পর্ক
ছিন্ন করতে হয় তাহলে বড়দের সঙ্গে পরামর্শ
করে একে অন্যের কল্যাণকামী হয়ে বুঝে-
শুনে, সঠিক মাসআলা জেনে নিয়ে মাসআলা
অনুযায়ী তালাক প্রদানের মাধ্যমে
বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে।
কিন্তু আফসোস! অধিকাংশ মানুষ মাসআলা
জানার চেষ্টাও করে না, আর না তাদের
মধ্যে এই সুবুদ্ধি আছে যে, বড়দের সাথে
পরামর্শ করবে, চিন্তা-ভাবনা করবে। নিজের
ইচ্ছাবিরোধী কোনো কিছু পেলেই রাগের
বশে তালাক দিয়ে ফেলে। আর তা এক বা
দুইটি নয়; এক নিঃশ্বাসে তিন তালাক।
যখন রাগ প্রশমিত হয় তখন অনুতপ্ত হয় এবং
বিভিন্ন ধরনের কথা বানাতে থাকে। বলে,
আমি রাগের মাথায় বলে ফেলেছি, তালাক
দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। এসব লোকের জেনে
রাখা উচিত যে, তালাক পতিত হওয়ার জন্য
নিয়তের কোনো প্রয়োজন নেই। এটা কোনো
ইবাদত নয় যে, এর জন্য নিয়ত করতে হবে।
নিয়ত থাক বা না থাক সর্বাবস্থায় তালাক
শব্দ বলে ফেললে বা কাগজে লিখে দিলেই
তালাক হয়ে যায়। তেমনিভাবে রাগের
অবস্থায় তালাক দিলেও তালাক হয়ে যায়,
এমনকি হাস্যরস বা ঠাট্টাচ্ছলে তালাক
দিলেও তা পতিত হয়ে যায়।
অবশ্য কেউ যদি প্রচন্ড রেগে যায় ও রাগের
ফলে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আর এ অবস্থায় সে কী
বলেছে তার কিছুই মনে না থাকে তাহলে ঐ
অবস্থার তালাক কার্যকর হবে না।
শেষকথা এই যে, দাম্পত্য জীবন আল্লাহ
তাআলার পক্ষ থেকে অনেক বড় ও বিশেষ
একটি নেয়ামত। স্বামী-স্ত্রী সকলের কর্তব্য,
এই নেয়ামতের যথাযথ মূল্যায়ন করা এবং
একে অপরের সকল অধিকার আদায় করা।
স্ত্রীর জন্য উচিত নয়, কথায় কথায় স্বামীর
কাছে তালাক চাওয়া। আবার স্বামীর জন্যও
জায়েয নয় আল্লাহ তাআলার দেওয়া ক্ষমতার
অপব্যবহার করা।
বিয়ে, তালাক ও দাম্পত্য জীবনের সকল
বিধান ও মাসআলা শিক্ষা করা স্বামী-স্ত্রী
উভয়ের জন্য জরুরি। বিশেষ করে স্বামীর
কর্তব্য হল, তালাকের মাসআলা ও এর
পরিণতি সম্পর্কে অবগত না হয়ে মুখে কখনো
তালাক শব্দ উচ্চারণ না করা। আর যদি
কোনো কারণে তালাক দেয় এবং এমনভাবে
দেয় যে, এখন আর তাদের একসাথে থাকা
শরীয়তে বৈধ নয় তাহলে তাদের আল্লাহকে
ভয় করা উচিত। বিভিন্ন টাল-বাহানা,
অজুহাতের আশ্রয় নিয়ে কিংবা ভুল কথার
উপর ভিত্তি করে অথবা মূল ঘটনা গোপন
রেখে একসাথে বাস না করা উচিত। বিয়ে শুধু
একটি সময়ের বিষয় নয়, সারা জীবনের বিষয়।
বাস্তবেই যদি তালাক হয়ে যায় এবং
শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈবাহিক সম্পর্ক শেষ
হয়ে যায় এরপরও স্বামী-স্ত্রী হিসেবে
একসাথে বাস করে তাহলে তা হবে কবীরা
গুনাহ এবং উভয়েই যেন ব্যভিচারের গুনাহয়
লিপ্ত।
আল্লাহ তাআলা সকলকে হেফাযত করুন এবং
তাকওয়া ও পবিত্রতা দান করুন। আমীন।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলাদেশী মেয়েদের হট ছবি

হে যুবক কোন দিকে যাও!! জান্নাতি হুর তোমাকে ডাকছে

ইসলামের দৃষ্টিতে যৌন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও শক্তি বৃদ্ধিকারী খাদ্য-পানীয়